চাচাদের বাধায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন হলো না চার বছরের ছোট্ট ফাহাদ
প্রবাসী বাবার কান্নায় ভেসেছে ভিডিও কলের পর্দা

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার গাংকুল পাড়ায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। মাত্র চার বছরের শিশু ফাহাদ মিয়া— যে প্রতিদিন বাবাকে দেখতে চাইত, বাবার কোলে ঘুমোতে চাইত—আজ সেই বাবার অনুপস্থিতিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলো। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টের বিষয়, তাকে দাদা-দাদির কবরের পাশে শুইয়ে দেওয়ার শেষ ইচ্ছাটাও পূরণ হলো না।
শনিবার ১২ অক্টোবর সকালে ছোট্ট ফাহাদের নিথর দেহটি ঘিরে কান্নার সাগর। গ্রামের মানুষ, আত্মীয়স্বজন সবাই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে—এমন নিষ্ঠুরতা কি সম্ভব?
ফাহাদের বাবা আল মামুন বাবুল মিয়া, সৌদি আরবে গাড়ি চালান। হাজার মাইল দূরে, কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও যিনি প্রতিদিন ফোনে ছেলের হাসিমুখ দেখতে চাইতেন, সেই বাবা যখন ফোনে শুনলেন—“তোমার ফাহাদ আর নেই”—ভেঙে পড়লেন সম্পূর্ণভাবে।
চোখের পানি ধরে রাখতে না পেরে ভিডিও কলে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“ওকে আমার বাবা-মায়ের পাশে শুইয়ে দাও… ও আমার জান, ও আমার সব।”
বিজ্ঞাপন
কিন্তু ভাগ্য যেন আরও একবার নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। শিশুটির চাচাতো চাচারা এসে কবর খোঁড়ার কাজ বন্ধ করে দিলেন। বললেন,
“এই কবরস্থানে আর কাউকে দাফন হবে না।”
শিশুর মা ও আত্মীয়রা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না, দাদা-দাদির পাশে একটু জায়গা পাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে পারে মাত্র চার বছরের এক প্রাণ।
স্থানীয়রা জানান, বহু বছর ধরে এই কবরস্থানটি যৌথ (এজমালি) হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি জায়গার দাম বেড়ে যাওয়ায় পারিবারিক বিরোধ চরমে উঠেছে। আর সেই বিরোধের বলি হলো এক নিষ্পাপ শিশু।
গ্রামবাসীর এক নারী কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“ওর মতো একটা ফেরেশতার জায়গা নিয়েও এত বিরোধ! আল্লাহর ঘরে জায়গা দিতে মানুষ বাধা দেয় কেমন করে?”
প্রবাসী বাবার বন্ধু রায়হান আকন্দ বলেন, “বাবুল ভাই প্রবাস থেকে ফোনে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, ছেলেকে যেন দাদা-দাদির পাশে দাফন করি। কিন্তু এখানে এসে দেখি কবর খোঁড়ার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এতটুকু জায়গা দিতে পারল না তারা!”
এ সময় এলাকাজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কেউ ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে পাকুন্দিয়া থানা পুলিশ। কিন্তু ততক্ষণে পরিবারের হৃদয় ভেঙে চুরমার।
শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ছোট্ট ফাহাদকে দাফন করা হয় তার বাবার ফসলি জমিতে—যেখানে কোনো দাদা-দাদির কবর নেই, নেই প্রিয়জনের ছায়াও।
স্থানীয় ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান অসহায় কণ্ঠে বলেন, “আমরা অনেক বুঝিয়েছি, ও তো একটা শিশু। কিন্তু তারা শুনল না। শিশুর বাবার ইচ্ছাও পূরণ হলো না।”
চাচাতো ভাই আসিফ মিয়া জানিয়েছেন, “আমার বড় ভাই সোহেল বিদেশে আছে। সে বলেছে এখানে কবর না দিতে, তাই আমি বাধা দিয়েছি।”
পাকুন্দিয়া থানার এসআই আতিকুর রহমান রাসেল বলেন, “পরিবার ৯৯৯-এ ফোন দিলে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। দুই পক্ষকে বুঝিয়ে অবশেষে শিশুটির বাবার নিজস্ব জমিতে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।”
গ্রামজুড়ে এখন কেবল নীরবতা—যেন মাটিও কাঁদছে ছোট্ট ফাহাদের জন্য।
এক প্রতিবেশী বলেন,
“ফাহাদ শুধু চেয়েছিল তার বাবাকে একবার দেখতে, বাবার কোলেই ঘুমোতে। কিন্তু বাবার অপেক্ষায় থাকা সেই ছেলেটা এখন ঘুমোচ্ছে মাটির নিচে—দাদা-দাদির পাশে নয়, নিজের ঘর থেকেও দূরে।”
এই ঘটনাটি শুধু একটি পরিবারের নয়, এটি গোটা সমাজের জন্য এক মর্মস্পর্শী প্রশ্ন—মানবিকতা কি আজ এতটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যে শিশুর কবরের জায়গাটুকুও আমরা নিয়ে তর্ক করি?
