ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি জেলে
গাদ্দাফির অর্থ কেলেঙ্কারিতে পাঁচ বছরের সাজা কার্যকর

ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি এখন বন্দি। লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছ থেকে নির্বাচনী তহবিল নেওয়ার অভিযোগে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের সাজা ভোগ করতে হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো কোনো ফরাসি সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানকে জেলে যেতে হলো। এর আগে ১৯৪৫ সালে নাৎসি সহযোগী নেতা ফিলিপ পেতাঁকে দেশদ্রোহের মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
সোমবার সকালে (স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে) প্যারিসের দক্ষিণাংশের মঁপারনাস এলাকার কুখ্যাত লা সান্তে কারাগারে প্রবেশ করেন ৭০ বছর বয়সী সারকোজি। কারাগারের চারপাশে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়, পুরো এলাকা ঘিরে রাখে পুলিশ।
পরিবারের ভালোবাসায় বিদায়
সাজা কার্যকরের আগে প্যারিসের অভিজাত ১৬তম এলাকার নিজ বাড়ি থেকে স্ত্রী কার্লা ব্রুনি-সারকোজির হাত ধরে বের হন সারকোজি। বাড়ির সামনে উপস্থিত শতাধিক সমর্থক তাকে ঘিরে স্লোগান দিতে থাকেন—“নিকোলা! নিকোলা!”। বড় ছেলে লুই সারকোজি (২৮) আগেই সমর্থকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন বাবাকে সমর্থন জানাতে। আর অন্য ছেলে পিয়ের সারকোজি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, “ভালোবাসা পাঠান, এর বেশি কিছু নয়।”
“আমি নির্দোষ, ফ্রান্স আজ প্রতিশোধের শিকার”
কারাগারে যাওয়ার পথে এক্স -এ সারকোজি লিখেন,
“আমার কোনো সন্দেহ নেই—সত্য অবশ্যই বিজয়ী হবে। কিন্তু এই সত্যের জন্য যে মূল্য দিতে হচ্ছে, তা ভয়াবহ।”
তিনি আরও লেখেন,
“আজ তারা কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টকে নয়, এক নির্দোষ মানুষকে বন্দি করছে। আমার জন্য দুঃখ করবেন না, কারণ আমার স্ত্রী ও সন্তানরা আমার পাশে আছে। তবে আজ আমি ফ্রান্সের জন্য গভীর বেদনা অনুভব করছি—একটি প্রতিশোধপ্রবণ ইচ্ছার কারণে অপমানিত হলো আমার দেশ।”
একাকী সেলে বন্দি সারকোজি
সারকোজিকে রাখা হয়েছে কারাগারের একাকী বন্দিত্ব বিভাগে । তাঁর সেলের আকার ৯ থেকে ১১ বর্গমিটার (প্রায় ৯৫ থেকে ১২০ বর্গফুট)। সেলে রয়েছে একটি টয়লেট, শাওয়ার, ডেস্ক, ছোট চুলা ও টেলিভিশন। টেলিভিশনের জন্য মাসে ১৪ ইউরো দিতে হবে। চাইলে একটি ছোট ফ্রিজ রাখারও অনুমতি আছে।
তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি অন্য কোনো কয়েদির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। প্রতিদিন মাত্র এক ঘণ্টা ব্যায়ামের সুযোগ পাবেন, সেটিও আলাদা প্রাঙ্গণে একাই করতে হবে।
কারাগারের সাবেক উপপরিচালক ফ্লাভি রল্ট এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “একাকী বন্দিত্বের পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন। বন্দি সব সময় একা থাকে, কেবল কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানসিকভাবে ভয়ানক প্রভাব ফেলে।”
“বিশেষ সুবিধা চাই না”
সারকোজি জানিয়েছেন, তিনি কারাগারে কোনো বিশেষ সুবিধা চান না। তবে তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বে দেখা হচ্ছে। ফ্রান্সের বিচারমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানিন জানিয়েছেন, তিনি নিজে কারাগার পরিদর্শনে যাবেন সারকোজির নিরাপত্তা ও সঠিক তদারকি নিশ্চিত করতে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁও বলেন, “মানবিক দিক থেকে আমি মনে করি, এই পরিস্থিতিতে আমার এক সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানকে দেখা একেবারে স্বাভাবিক।”
দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত সারকোজি
২০১২ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকেই সারকোজির বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থায়নের মামলা চলছে। গত বছর ডিসেম্বরেও এক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে তাকে ইলেকট্রনিক ট্যাগ পরে বাড়িতে নজরদারিতে থাকতে হয়েছিল।
আগামী মাসে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আদালত তার বিরুদ্ধে ‘বিগমালিয়ঁ কেলেঙ্কারি’ মামলার ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দেবে।
গাদ্দাফি তহবিল কেলেঙ্কারি
২০০৭ সালের নির্বাচনে সারকোজির প্রচারণায় লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছ থেকে কয়েক মিলিয়ন ইউরো অবৈধভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল—এমন অভিযোগেই তার বিরুদ্ধে এ মামলা হয়। যদিও সারকোজি ব্যক্তিগতভাবে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু আদালত মনে করে তিনি তার দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী ব্রিস হর্তেফ্যু ও ক্লদ গ্যুয়ঁ-এর মাধ্যমে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন।
এই দুই সহযোগী ২০০৫ সালে গাদ্দাফির গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন, যা আয়োজন করেছিলেন ফ্রান্স-লেবাননের মধ্যস্থতাকারী জিয়াদ তাকেদ্দিন। সম্প্রতি তাকেদ্দিন লেবাননে মারা যান।
আদালত বলেছে, মামলার “অত্যন্ত গুরুতর প্রকৃতি” বিবেচনায় সারকোজিকে জেলে যেতে হবে, যদিও আপিল প্রক্রিয়া চলমান থাকায় তিনি আইনত এখনো “নির্দোষ” হিসেবে গণ্য।
“আমি ভয় পাই না”
কারাগারে যাওয়ার আগে ফরাসি সংবাদপত্র লা ত্রিব্যুন -কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সারকোজি বলেন,
“আমি জেলকে ভয় পাই না। মাথা উঁচু করে যাব, জেলের ফটক পর্যন্ত।”
জেলে যাওয়ার সময় তিনি সঙ্গে নিয়েছেন দুটি বই—জাঁ-ক্রিস্তিয়াঁ পেতিফিলস রচিত ‘জীশুর জীবন’ এবং আলেক্সান্দ্র দ্যুমা-র বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য কাউন্ট অব মন্টে ক্রিস্টো’, যেখানে এক নির্দোষ বন্দি প্রতিশোধ নেয় তার ওপর অন্যায় করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।
ফ্রান্স এ আরও খবর
