ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত ৮৪, যুদ্ধবিরতি আলোচনা চলেছে কাতারে

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত ৮৪, যুদ্ধবিরতি আলোচনা চলেছে কাতারে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশঃ মে 15, 2025 8:41 পূর্বাহ্ন

গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর টানা বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৮৪ জন ফিলিস্তিনি। আল জাজিরাকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় চিকিৎসা কর্মকর্তারা।

বুধবার দিনের শুরু থেকে গাজার উত্তরের জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে চালানো হামলায় অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনুসেও প্রাণ হারিয়েছেন আরও ১০ জন।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কেবল জাবালিয়া এলাকাতেই নিহত হয়েছেন প্রায় ৫০ জন।

হামলার ব্যাপারে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

জাবালিয়ায় ধ্বংসস্তূপের নিচে শিশুর মরদেহ উদ্ধার

জাবালিয়ায় বিধ্বস্ত ভবনের নিচে আটকে পড়া মরদেহ উদ্ধারে উদ্ধারকর্মীরা কাজ করছেন হাতে ধরা যন্ত্রপাতি ও মোবাইল ফোনের আলো ব্যবহার করে। ধসে পড়া কংক্রিট সরিয়ে একের পর এক শিশুদের মরদেহ বের করে আনা হচ্ছে। দৃশ্যপট যেন এক বিভীষিকাময় মানবিক ট্র্যাজেডি।

‘বাসিন্দাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করাই লক্ষ্য’ — আল জাজিরার প্রতিবেদন

আল জাজিরার সাংবাদিক তারেক আবু আজজুম, যিনি গাজার কেন্দ্রীয় শহর দেইর আল-বালাহ থেকে প্রতিবেদন দিচ্ছেন, বলেন, “ইসরায়েল একটি পরিকল্পিত ও ক্রমবর্ধমান বিমান হামলা অভিযানে নিয়োজিত হয়েছে, যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আবাসিক ভবন। উদ্দেশ্য হলো মানুষকে ভয় দেখিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে শরণার্থী শিবির বা অস্থায়ী তাঁবুতে ঠেলে দেওয়া, যাতে তাদেরকে উত্তর গাজা থেকে চূড়ান্তভাবে সরিয়ে দেওয়া যায়।”

তিনি আরও বলেন, “গত এক সপ্তাহ ধরে শিশুরা ও তাদের পরিবার যে দুর্দশার মধ্যে রয়েছে, এই হামলা সেই মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রাকে আরও গভীর করে তুলেছে।”

যুদ্ধবিরতির আলোচনার মাঝেই চালানো হচ্ছে হামলা

এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মাঝেই কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলি একটি প্রতিনিধি দল হামাসের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় চলছে এই যুদ্ধবিরতির আলোচনা।

এর আগে, এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতির সময় ইসরায়েলি-মার্কিন দ্বৈত নাগরিক এডান আলেক্সান্ডারকে মুক্তি দেয় হামাস, যাকে নিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতির ইঙ্গিত মিলেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ আল জাজিরাকে জানান, “যুদ্ধবিরতি ও গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশ— উভয় দিকেই বড় অগ্রগতি হয়েছে। আমরা আশা করছি, খুব শিগগিরই একটি ইতিবাচক ঘোষণা আসবে।”

নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারি: যুদ্ধ চলবে যতোক্ষণ না লক্ষ্য পূরণ হয়

তবে অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, “যদিও আলোচনা চলছে, তবে যুদ্ধবিরতি হলেও আমাদের সামরিক অভিযান বন্ধ হবে না। হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস না করা পর্যন্ত অভিযান চলবে।”

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের এক বিস্ময়কর হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ১,১৩৯ জন নিহত হয়। এরপর থেকেই ইসরায়েল গাজায় টানা সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবর ২০২৩ থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৫২,৯০৮ জন ফিলিস্তিনি

এই অভিযানে গাজার শহরগুলো প্রায় পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাজার ৯০ শতাংশের বেশি বাসিন্দা একাধিকবার বাসস্থান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।


মানবিক বিপর্যয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

‘একটি লজ্জাজনক কাজ করছে নেতানিয়াহুর সরকার’ — ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ

গাজায় অবরোধ তুলে না নিলে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী— এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সরাসরি নেতানিয়াহুকে দায়ী করে বলেন, “আজকে যা ঘটছে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। কোনো ওষুধ নেই, আহতদের বের করে আনা যাচ্ছে না, চিকিৎসকরা ঢুকতে পারছেন না। নেতানিয়াহু যা করছেন, তা একটি লজ্জাজনক কাজ।”

তিনি ফরাসি জাতীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সীমান্ত খুলে দিতে হবে, যাতে মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে পারে। এরপর হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ, জিম্মিদের মুক্তি এবং একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথে যেতে হবে।”

নেতানিয়াহুর পাল্টা জবাব: ‘ম্যাক্রোঁ সন্ত্রাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন’

ম্যাক্রোঁর বক্তব্যের জবাবে নেতানিয়াহুর দপ্তর থেকে বিবৃতিতে বলা হয়, “ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট একটি ইসলামি সন্ত্রাসী সংগঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।”

৫ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে, ১০ লাখের খাদ্য সংকট

গাজায় বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ মানুষ চরম দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে, এবং আরও ১০ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা Integrated Food Security Phase Classification (IPC)

গত ১০ সপ্তাহে ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের খাদ্য, ওষুধ, পানি, ত্রাণসামগ্রী প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছে। এ সময়ের মধ্যেই চালিয়েছে লাগাতার বিমান হামলা ও স্থল অভিযান।

গাজার প্রায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষের অধিকাংশই বাইরের সহায়তার ওপর নির্ভর করে জীবনধারণ করেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ ও অবরোধে গাজার খাদ্য উৎপাদনের সক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।


এক নজরে গাজা সংকট:

  • নিহত: অক্টোবর ২০২৩ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত ৫২,৯০০+
  • বাস্তুচ্যুত: গাজার ৯০% জনগণ একাধিকবার গৃহহীন
  • দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে: ৫ লাখ
  • চিকিৎসা সংকট: হাসপাতালে ওষুধ নেই, চিকিৎসক প্রবেশে বাধা
  • আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: ফ্রান্স, কাতার, মিসর, যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে

গাজা এখন এক মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দু। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর সেখানে থাকলেও, মানুষের কান্না আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে শান্তির আশাব্যঞ্জক কোনো চিহ্ন এখনো সুস্পষ্ট নয়।

0%
0%
0%
0%