ইসরায়েলি হামলায় এক চিকিৎসকের সাত সন্তান নিহত, দুই শিশু নিখোঁজ, স্বামী আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত একই পরিবারের সাত শিশু, দুইজন নিখোঁজ; বেঁচে আছেন মাত্র দুইজন

শিশুদের বাবা হামদি আল-নাজ্জার আগুনে পুড়ে ও গুলিবিদ্ধ হয়ে শনিবার গাজার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশঃ মে 26, 2025 4:05 অপরাহ্ন

গাজা উপত্যকার খান ইউনিস শহরের দক্ষিণাঞ্চলে শুক্রবার বিকেলে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে এলাকা। ওই বিস্ফোরণটি ছিল ইসরায়েলি বিমান হামলা, যেখানে নিহত হয়েছে একটি পরিবারের সাত শিশু। নিখোঁজ রয়েছে আরও দুই শিশু, যাদের ধ্বংসস্তূপের নিচে মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নাসের হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আলা আল-নাজ্জার ঘটনার সময় কর্মস্থলে ছিলেন। হঠাৎ খবর পান, তাদের এলাকা ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে যান সেখানে। ভাইপো মোহাম্মদ আল-নাজ্জার ও দেবর আলি আল-নাজ্জার জানান, ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিজের সন্তানের পোড়া মরদেহ শনাক্ত করেন আলা।

আলি আল-নাজ্জার বলেন, “আমরা তিনটি পোড়া মরদেহ টেনে বের করেছি, চতুর্থটিকে বের করছিলাম তখনই সে (ডা. আলা) ছুটে এসে একনজর দেখেই তাদের চিনে ফেলে।”

গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবারের বরাত দিয়ে বলা হয়, ১০ সন্তান থাকলেও এ ঘটনায় নিহত হয়েছে অন্তত সাতজন। দুই শিশু নিখোঁজ, ধ্বংসস্তূপের নিচে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা।

পরিবারটি দক্ষিণ খান ইউনিসের কিজান আল-নাজ্জার এলাকায় বসবাস করত। পাশের ভবনে গাড়ির টায়ার মজুদ ছিল, যা বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তাদের ঘরেও।

আহতদের মধ্যে রয়েছেন ডা. আলা’র স্বামী হামদি আল-নাজ্জার ও তাদের সন্তান আদম। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের প্রধান ডা. আহমেদ আল-ফাররা জানান, হামদি মারাত্মক মস্তিষ্কে আঘাত পেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন, আর আদমের অবস্থা মাঝারি।

ডা. আলা প্রায় এক দশক ধরে নাসের হাসপাতালে শিশু রোগের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। ডা. ফাররা জানান, “তিনি অত্যন্ত মমতাময়ী ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতেন।”

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী “একাধিক সন্দেহভাজনকে লক্ষ্য করে” আঘাত হেনেছে বলে জানায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)। তবে এখনো তারা নিশ্চিত করতে পারেনি যে এতে “নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক” ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কিনা।

৫০ হাজারের বেশি প্রাণহানি, বাড়ছে অসামরিক মৃত্যুর মিছিল

গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার জবাবে শুরু হওয়া যুদ্ধ এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে গাজায়। যদিও মন্ত্রণালয় বেসামরিক ও যোদ্ধাদের আলাদা করে তথ্য দেয় না, তথাপি প্রকাশিত তালিকায় হাজার হাজার শিশুর নাম রয়েছে।

৭ অক্টোবরের হামলায় ইসরায়েলে ১,২০০ জন নিহত হয় এবং প্রায় ২৫০ জনকে গাজায় জিম্মি করে নিয়ে যায় হামাস। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণ করেন, হামাসের বিরুদ্ধে এই অভিযান তাদের পরাজয়ের মাধ্যমে শেষ হবে।

কিন্তু অনেক সমালোচক, এমনকি ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও, মনে করছেন এই যুদ্ধের শেষ নেই। বরং প্রতিদিন বাড়ছে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা।

বাড়ছে হামলা, সরানো হচ্ছে বাসিন্দাদের

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, খান ইউনিস এলাকায় অভিযানের আগে তারা সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। “এলাকাটি বিপজ্জনক যুদ্ধাঞ্চল। সবার নিরাপত্তার জন্যই সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল,” — এমনটাই জানানো হয় নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক বিবৃতিতে।

কিন্তু আলি আল-নাজ্জার জানান, ১০টি সন্তানসহ একটি পরিবারকে নিয়ে তাঁবুর শিবিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সেই শিবিরগুলো অস্বাস্থ্যকর, পানিহীন ও অনিরাপদ।

তিনি আরও বলেন, “নিজের বাড়িতে তাদের পানি ছিল, সৌরবিদ্যুৎ ছিল। কিন্তু তবু শেষ রক্ষা হলো না।”

টাইমসের ভিডিও যাচাই, ৯ জন এখনো ধ্বংসস্তূপে

নিউইয়র্ক টাইমস যাচাইকৃত এক ভিডিওতে দেখা যায়, ফিলিস্তিনি উদ্ধারকর্মীরা ছোট ছোট পোড়া দেহ বহন করে আনছে ওই ভবন থেকে। একজন চিৎকার করে বলছেন, “নিচে এখনো ৯ জন রয়েছে!”

গাজা কর্তৃপক্ষ জানায়, হামলায় কেবল দুইজনই বেঁচে গেছেন বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলি আক্রমণের নিয়ম-কানুন ও যুদ্ধের নীতিমালার ওপর আবারও প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে।

0%
0%
0%
0%