জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ: নতুন বাংলাদেশের প্রত্যয়

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ: নতুন বাংলাদেশের প্রত্যয়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশঃ মার্চ 11, 2025 1:55 পূর্বাহ্ন

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ: নতুন বাংলাদেশের প্রত্যয়। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছেন, “বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রেখে রাষ্ট্রকে বিনির্মাণ করব।”

ঐতিহাসিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

আজ বিকেল ৪টার পর পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পরে পবিত্র গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ছাত্র, যুবক, সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতারা অংশগ্রহণ করেন। বিপুল জনসমাগমে পুরো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ মুখরিত হয়ে ওঠে। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

নাহিদ ইসলামের দৃঢ় প্রত্যয়

নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যের শুরুতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক নেতাদের শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, “আমরা অতীতের বিভাজন নয়, সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের কথা বলতে চাই। বিকল্প রাজনীতির দর্শন নিয়েই জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ।”

তিনি আরও বলেন, “আজকের এই মঞ্চ থেকে শপথ করছি—বাংলাদেশকে আর বিভাজিত হতে দেব না। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করব।”

ঘোষণাপত্র: নতুন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি

জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে একটি লিখিত ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়, যেখানে বলা হয়েছে:

“জুলাই ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে, আমরা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ঘোষণা করছি—আমাদের লক্ষ্য একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।”

ঘোষণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করলেও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরাচারের পতন ঘটলেও বিগত ১৫ বছর দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম ছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে একদলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে জনগণের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। তবে, জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান জনগণকে নতুন আশার আলো দেখিয়েছে।

সেকেন্ড রিপাবলিকের ঘোষণা

নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা মনে করি, জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার সূচনা করেছে। আমাদের অন্যতম লক্ষ্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা, যা গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।”

নতুন সংবিধানের মাধ্যমে:

  • শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে
  • রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে
  • পরিবারতন্ত্রের পরিবর্তে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে
  • দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা হবে
  • জনগণের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ করা হবে

অর্থনৈতিক সংস্কার ও সামাজিক ন্যায়বিচার

জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা একটি স্বনির্ভর ও বৈষম্যহীন অর্থনীতি গড়ে তুলবে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মূল দিকগুলো হলো:

  • কৃষি, সেবা ও উৎপাদন খাতের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি
  • সম্পদের সুষম বণ্টন
  • সিন্ডিকেট ও কর্পোরেট দখলদারিত্ব প্রতিরোধ
  • প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা
  • পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ

নতুন রাজনীতির সূচনা

নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাই, যেখানে প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার থাকবে; পরিবারতন্ত্র নয়, মেধা ও যোগ্যতা স্থান পাবে। জনগণই হবে ক্ষমতার একমাত্র উৎস।”

জাতীয় নাগরিক পার্টি একটি বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যেখানে সকল ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গের মানুষ সমান সুযোগ ও নিরাপত্তা পাবে।

ঐতিহাসিক যাত্রার শপথ

জাতীয় নাগরিক পার্টির এই আত্মপ্রকাশ শুধু একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম নয়, বরং এটি একটি নতুন স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের পথচলা। ঘোষণাপত্রের শেষে বলা হয়, “এখনই সময়—নতুন স্বপ্ন দেখার, নতুন পথচলার, এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার!”

জাতীয় নাগরিক পার্টির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে ঘোষণা দেন যে, তারা সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হবেন।

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা হলো।

সম্পর্কিত-
0%
0%
0%
0%