সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ঐতিহাসিক জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ স্বাক্ষর

নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশঃ 17 অক্টোবর 2025, 07:09 অপরাহ্ন
সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ঐতিহাসিক জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ স্বাক্ষর

বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ যুক্ত হলো এক নতুন অধ্যায়। শুক্রবার ১৭ অক্টোবর বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় উৎসবমুখর পরিবেশে স্বাক্ষরিত হলো বহুল প্রত্যাশিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’

বিজ্ঞাপন

বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটির সূচনা হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা একযোগে ঐতিহাসিক এই সনদে স্বাক্ষর করেন।


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পূর্ণ দলিল

৪০ পৃষ্ঠার এই সনদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো স্থান পেয়েছে। এতে রয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকাল, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ।

সনদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা এবং পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের প্রেক্ষাপট।

বিজ্ঞাপন

এতে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একক পরিবার, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে প্রভাবিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটে।

সনদে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের পরপর তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের মূল কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।


১৬ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বীকৃতি

সনদে গত ১৬ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০১৮ সালের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, ছাত্র-যুব সমাজের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান, যা “স্বৈরাচারবিরোধী জনজাগরণের পরিণতি” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।


সাত দফা অঙ্গীকার

সনদের শেষ অংশে রাখা হয়েছে সাতটি প্রতিশ্রুতি। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে।


প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন,

“আজ আমাদের নতুন জন্মের দিন। জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আমরা একটি নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করেছি। এটি আমাদের ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে, যা গত ১৬ বছরের নিষ্ঠুরতা ও স্বৈরাচারের অবসান ঘটাবে।”

তিনি আরও বলেন,
“এই পরিবর্তন এসেছে জনগণ ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংঘটিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এখন আমাদের সংবিধানে, শাসন ব্যবস্থায় ও জাতীয় জীবনে সেই পরিবর্তন বাস্তবায়ন করতে হবে।”

ড. ইউনুস আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তরুণ প্রজন্মই নতুন বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্ব দেবে।
“যে তরুণেরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে, তারাই আমাদের দেখাবে নতুন পথ। দেশের অর্ধেক মানুষই ২৭ বছরের নিচে—এই দেশ তাদেরই,” বলেন তিনি।

তিনি আরও যোগ করেন,
“জুলাই জাতীয় সনদ শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো বিশ্বের জন্যও একটি উদাহরণ। অনেক দেশ একদিন জানতে চাইবে কীভাবে গোটা জাতিকে সম্পৃক্ত করে আমরা এই সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি।”


পঞ্চম অনুচ্ছেদে সংশোধনী: জুলাই যোদ্ধাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রিয়াজ জানান, গতকাল জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনার পর সনদের পঞ্চম অনুচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়েছে, যা তাদের দাবি প্রতিফলিত করে।

সংশোধিত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,
“পূর্ব-গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময় গুম, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পাশাপাশি ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। শহীদদের রাষ্ট্রীয় সম্মান ও পরিবারদের স্বীকৃতি দেওয়া হবে। আহত জুলাই যোদ্ধাদের ‘রাষ্ট্রীয় বীর’ ঘোষণা করে তাদের জন্য মাসিক ভাতা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।”

প্রফেসর আলী রিয়াজ বলেন, “এই প্রতিশ্রুতি সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করবে কমিশন, এবং এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো মতভেদ নেই।”


জাতীয় ঐকমত্যের নতুন ভিত্তি

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস, কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা একযোগে সনদে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন ঐক্যের সূচনা ঘটেছে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ ও তরুণ প্রজন্মের শত শত সদস্য।

0%
0%
0%
0%