দক্ষিণ কোরিয়ার নির্বাচনে লি জে-মিয়ং-এর নিরঙ্কুশ জয়, দেশ পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার

ছবিঃ সংগ্রহকৃত
দক্ষিণ কোরিয়ায় নাটকীয় এক রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিরোধীদলীয় প্রার্থী লি জে-মিয়ং একটি নিরঙ্কুশ জয় অর্জন করেছেন। এই বিজয় এসেছে ছয় মাস পর, যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়লের সামরিক আইন জারির চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে ব্যাপক জনরোষের সৃষ্টি করে এবং তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অবসান ঘটায়।
ইউনের ওই সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিপর্যয়কর পদক্ষেপের কারণে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি অভিশংসিত হয়ে পদচ্যুত হন। বর্তমানে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি।
লি জে-মিয়ং-এর জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এই গভীরভাবে বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা, যা এখনও সেই রাজনৈতিক ঝড়ের অভিঘাতে দুলছে। পাশাপাশি তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির দর কষাকষি, যাতে দক্ষিণ কোরিয়ার উপর আরোপিত শুল্কের প্রভাব কিছুটা লাঘব করা যায়।
বিজয়ের পথে কঠিন লড়াই
লি’র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও ইউন সরকারের সাবেক মন্ত্রী কিম মুন-সু। নির্বাচন পূর্ববর্তী জরিপেই দেখা যাচ্ছিল কিম পিছিয়ে পড়েছেন, এবং বুধবার ভোরে তিনি পরাজয় স্বীকার করে লিকে অভিনন্দন জানান।
লি একটি আগের ভাষণে বিজয়ের ইঙ্গিত দিলেও সরাসরি ঘোষণা দেননি। তিনি বলেছিলেন, “দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারই হবে আমার সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার।”
এটা লি’র জন্য এক অসাধারণ প্রত্যাবর্তন। ২০২২ সালের নির্বাচনে ইউনের কাছে সামান্য ব্যবধানে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। এর পর তিনি একাধিক কেলেঙ্কারির মুখে পড়েন—দুর্নীতির অভিযোগ থেকে শুরু করে পারিবারিক ঝামেলা পর্যন্ত। তা সত্ত্বেও তিনি আবার জয় ছিনিয়ে আনলেন।
জনরায়ে গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার
রাজনৈতিক বিশ্লেষক পার্ক সুং-মিন বলেন, “এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ কেবল লির প্রতি সমর্থন জানাননি, বরং তারা একটি ভেঙে পড়া গণতন্ত্রের প্রতিবাদে আওয়াজ তুলেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “এটি ছিল একটি অসন্তোষ প্রকাশের মাধ্যম, যেখানে জনগণ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর ক্ষমতাসীন পিপল পাওয়ার পার্টির (PPP) সঙ্গে নেই।”
নির্বাচনের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ
ইউনের পদত্যাগের পর PPP দলে ব্যাপক বিভাজন দেখা দেয়। তারা এতটাই অগোছালো হয়ে পড়ে যে, প্রার্থী চূড়ান্ত করতেই সময় লেগে যায় মে মাস পর্যন্ত। এর মধ্যে দুইজন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্টও অভিশংসনের শিকার হন, যাদের একজন পরে আবার পুনর্বহাল হন।
এই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অবশ্য বিরোধীদল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও লি জে-মিয়ং-এর জন্য সুফল বয়ে আনে। তবে জয় পাওয়ার পরও তাঁর সামনে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। তিনি এখনও একটি সুপ্রিম কোর্টের মামলার মুখোমুখি—নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে। যদিও আদালত নির্বাচন চলাকালে মামলাটি স্থগিত রেখেছিল, এখন তাঁর ভাগ্য অনিশ্চিত। দক্ষিণ কোরিয়ার আইনে বর্তমান প্রেসিডেন্টদের বিচার করা যায় না, তবে বিদ্রোহ বা দেশদ্রোহিতার মতো অপরাধ ব্যতিক্রম।
ব্যক্তিগত জীবনের ছাপ রাজনীতিতে
লি জে-মিয়ং একজন স্বঘোষিত কর্মজীবী পরিবারে বেড়ে ওঠা মানুষ। মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে পরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ২০২২ সালে তিনি প্রথমবার প্রেসিডেন্ট পদে লড়েন।
সে সময়ে তিনি নারীর অধিকার ও সমতা নিয়ে একটি প্রগতিশীল ম্যান্ডেট নিয়ে প্রচার চালান। কিন্তু এবার তিনি কিছুটা কেন্দ্রমুখী নীতিতে অবস্থান নেন, যাতে বৃহত্তর জনগণের সমর্থন পেতে পারেন।
বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা বড় চ্যালেঞ্জ
এখন তাঁকে এমন একটি সংসদের মুখোমুখি হতে হবে, যেখানে তাঁর প্রতিপক্ষ PPP এখনও শক্তিশালী। তিনি যদিও “জাতীয় ঐক্য”র কথা বলেন, তবু রাজনৈতিক বিশ্লেষক পার্ক বলেন, “তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসাধ্য কাজ হবে—কীভাবে ইউনের কার্যক্রমের জবাবদিহি নিশ্চিত করবেন, আবার জাতিকে আরও বিভক্ত না করেই।”
ইউনের সমর্থকরা—বিশেষ করে তরুণ পুরুষ ও বয়স্ক ভোটার—তাঁকে এখনও সমর্থন করেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, সামরিক আইন ছিল দেশের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কেউ কেউ আবার নির্বাচনে কারচুপির তত্ত্ব প্রচার করছেন।
জানুয়ারিতে ইউনের গ্রেফতারের পর হাজার হাজার সমর্থক আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হন এবং পুলিশকে আক্রমণ করেন। ফলে তাঁর শূন্যস্থান পূরণের প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে লি জুন সিওক-এর নাম ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই তরুণ রাজনীতিক শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও তরুণ পুরুষদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে, বিশেষ করে নারীবাদবিরোধী বক্তব্যের কারণে।
এইসব কারণেই এবারের নির্বাচনে তরুণ পুরুষ ভোটারদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। মোট ভোটার উপস্থিতি ছিল ৭৯.৪ শতাংশ, যা ১৯৯৭ সালের পর সর্বোচ্চ।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কঠিন সময়
দেশীয় বিভাজনের পাশাপাশি লিকে এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক, বিশেষ করে নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে, তাঁর জন্য একটি বড় পরীক্ষা হবে।
বিশ্লেষক পার্ক বলেন, “দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ এখন বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।”
বাণিজ্য চুক্তি দ্রুত সম্পাদন করাই তাঁর প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, কারণ দেশের অর্থনীতি ইতোমধ্যেই মন্থর হয়ে পড়েছে।
জনগণের প্রতিশ্রুতি
নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর এক বিবৃতিতে লি বলেন, “জনগণ আমার উপর যে মহান দায়িত্ব ও মিশন অর্পণ করেছেন, তা পূরণে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, যাতে তাদের প্রত্যাশা ব্যর্থ না হয়।”
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এ যেন এক নাটকীয় মোড়, যেখানে গণতন্ত্রের পক্ষে জনগণের রায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এখন দেখার বিষয়, লি জে-মিয়ং কতটা সফল হন এই বিভক্ত জাতিকে আবার একত্রিত করতে।