ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংসের স্বীকারোক্তি ঘিরে তোলপাড়, মোদি সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে কংগ্রেস

ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সামরিক সংঘাতে পাকিস্তানি আগুনে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস হওয়ার স্বীকারোক্তি ঘিরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক। ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন শিব কুমার এ নিয়ে মন্তব্য করার পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এই ঘটনা এখন মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দল কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
কি ঘটেছিল ৭ মে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে?
৭ মে, অপারেশন সিন্ধুর (Operation Sindoor) নামে একটি সামরিক অভিযানে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের ছয়টি শহরে একযোগে নয়টি লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। এর জবাবে পাকিস্তান দাবি করে, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছয়টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে তিনটি রাফাল (Rafale) বিমান ছিল।
দু’দেশই দাবি করেছে, কোনও যুদ্ধবিমানই সীমান্ত অতিক্রম করেনি। কিন্তু আকাশপথে এই লড়াইয়ের পরে ১০ মে পর্যন্ত উভয় দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চলে। অবশেষে ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি হয়, যদিও ভারত তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা অস্বীকার করে।
ক্যাপ্টেন শিব কুমার ঠিক কী বলেছিলেন?
১০ জুন ইন্দোনেশিয়ার এয়ার মার্শাল সূর্যধর্মা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কুমার বলেন—
“আমি বলবো না যে আমরা অনেকগুলো বিমান হারিয়েছি, তবে হ্যাঁ, কিছু বিমান হারিয়েছিলাম। আর সেটা হয়েছিল কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমাদের সামরিক বাহিনীকে পাকিস্তানের সামরিক স্থাপনা বা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত না করতে নির্দেশ দিয়েছিল।”
তিনি আরও জানান, পরে ভারতীয় বাহিনী কৌশল পরিবর্তন করে পাকিস্তানের সামরিক স্থাপনায় সরাসরি হামলা শুরু করে। ব্রহ্মোস (BrahMos) ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানের এয়ারবেস লক্ষ্য করে আঘাত হানা হয় ৯-১০ মে রাতে।
ভারত সরকার ও সেনাবাহিনীর আগের অবস্থান কী ছিল?
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি আসার পর ভারত সরকার প্রথমে এই দাবিকে ‘ভুয়া তথ্য’ বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু এরপর ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা পরোক্ষভাবে স্বীকার করতে থাকেন যে কিছু বিমান ধ্বংস হয়েছে।
১১ মে, ভারতীয় বিমান বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অফ এয়ার অপারেশনস এ কে ভারতী বলেন,
“যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ক্ষয়ক্ষতি স্বাভাবিক। আমরা এখনও লড়াই করছি, তাই বিস্তারিত বলা উচিত নয়।”
পরবর্তীতে, সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত Shangri-La Dialogue নিরাপত্তা সম্মেলনে ভারতের চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান স্বীকার করেন যে পাকিস্তানি হামলায় ভারতীয় বিমান ধ্বংস হয়েছে। তবে তিনি ছয়টি বিমান ধ্বংস হওয়ার দাবিকে ভুল বলে উল্লেখ করেন।
ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া কী?
২৯ জুন ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত ভারতীয় দূতাবাস এক বিবৃতিতে দাবি করে—
“শিব কুমারের মন্তব্যকে প্রেক্ষাপটের বাইরে নিয়ে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে ভারতের সামরিক পদক্ষেপ ছিল সুপরিকল্পিত, আত্মসংযমপূর্ণ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশনায় পরিচালিত।”
এই বিবৃতিতে পরোক্ষভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকেও কটাক্ষ করে বলা হয়—
“ভারতের সশস্ত্র বাহিনী বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে কাজ করে, যেটা আমাদের প্রতিবেশী দেশের মতো নয়।”
কংগ্রেসের কড়া প্রতিক্রিয়া
ভারতের প্রধান বিরোধী দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এই স্বীকারোক্তিকে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে “জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে গোপনীয়তা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার প্রমাণ” বলে উল্লেখ করেছে।
পবন খেরা বলেন,
“মোদি সরকার প্রথম থেকেই দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করেছে। অপারেশন সিন্ধুর সময় বিমান হারানোর সত্য গোপন করেছে। এখন স্পেশাল পার্লামেন্ট সেশন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কারণ সত্য প্রকাশ হলে মোদি সরকারের ব্যর্থতা ধরা পড়বে।”
জয়রাম রমেশ প্রশ্ন তোলেন—
“প্রধানমন্ত্রী কেন সর্বদলীয় বৈঠক ডাকছেন না? কেন সংসদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বানকে এড়িয়ে যাচ্ছেন?”
এই সংঘাতের সূচনা কীভাবে হয়েছিল?
২২ এপ্রিল ভারতের জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাম অঞ্চলে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হন। দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (TRF) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করে। ভারত দাবি করে, এটি পাকিস্তান-ভিত্তিক লস্কর-ই-তইয়্যেবা (LeT)-এর একটি ছদ্মবেশী সংগঠন। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানায়।
এই হামলার পরই দুই দেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে যায় এবং শুরু হয় কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নকরণ ও সামরিক উত্তেজনা।
সংক্ষেপে:
- ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংসের বিষয়টি প্রথমে গোপন রাখা হলেও এখন একাধিক সামরিক কর্মকর্তা তা স্বীকার করেছেন।
- শিব কুমারের মন্তব্য মোদি সরকারের নির্দেশনায় সামরিক কৌশলে সীমাবদ্ধতা আরোপের ইঙ্গিত দিয়েছে।
- বিরোধী দল কংগ্রেস এই স্বীকারোক্তিকে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে মোদি সরকারের “ব্যর্থতা” হিসেবে তুলে ধরছে।
- রাজনৈতিক চাপ বাড়লেও ভারত সরকার তার অবস্থানেই অনড় রয়েছে যে “তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।”
এই ঘটনার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব কী হতে পারে, সেটি নজরে রাখছে গোটা দক্ষিণ এশিয়া।