১৮৫ বছর পর নেপালে পুনরাবির্ভাব: খুদে এশীয় উটচর আবারও দেখা দিলো নদীর মোহনায়

ছবিঃ সুটারস্টোক
প্রায় ১৮৫ বছর ধরে নিখোঁজ থাকার পর অবশেষে নেপালে ফের দেখা মিলল বিশ্বের সবচেয়ে ছোট প্রজাতির উটচর — এশীয় খুদে উটচর (Asian Small-Clawed Otter)। একে এক অলৌকিক প্রত্যাবর্তন হিসেবেই দেখছেন বন্যপ্রাণী গবেষকরা। এই ছোট্ট প্রাণীটির হঠাৎ আবির্ভাব যেমন আশার আলো জাগায়, তেমনি নেপালের হিমালয়ঘেরা পরিবেশে বিপন্ন প্রাণীদের সংরক্ষণ নিয়ে জরুরি সতর্কবার্তাও দিয়ে যায়।
দুই নদীর সংযোগস্থলে উদ্ধার খুদে উটচর
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে নেপালের দাদেলধুরা জেলার রংগুন ও পুন্তারা নদীর মোহনায় আহত অবস্থায় পাওয়া যায় একটি অল্প বয়সী উটচরকে। অনেকেই তখন জানতেন না— এত বছর পর এটি যে প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করছে তা এককথায় ঐতিহাসিক। ১৮৩৯ সালের পর থেকে এশীয় খুদে উটচরের আর কোনো নিশ্চিত উপস্থিতি পাওয়া যায়নি নেপালে, ফলে এটিকে কার্যত বিলুপ্ত বলেই মনে করা হচ্ছিল।
স্থানীয় বন কর্মকর্তারা আহত প্রাণীটিকে উদ্ধার করে সেবা-শুশ্রূষা করেন। পরে ছবি ও ভিডিও পাঠানো হয় বন্যপ্রাণী গবেষকদের কাছে। চীনের সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটি অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষক মোহন বিক্রম শ্রেষ্ঠ ও আইইউসিএনের (IUCN) উটচর বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় নিশ্চিত হওয়া যায়— এটি সত্যিই বহু বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া এশীয় খুদে উটচর।
গবেষক মোহন বিক্রম শ্রেষ্ঠ বলেন, “এটি নেপালের সংরক্ষণ ইতিহাসে এক অসাধারণ আবিষ্কার। আমরা ভেবেছিলাম এই প্রজাতিটি চিরতরে হারিয়ে গেছে, অথচ প্রকৃতি আবার একবার আমাদের চমকে দিল।”
বিপদের মুখে নেপালের উটচর ও নদী বাস্তুতন্ত্র
এই আবিষ্কার যেমন আনন্দের, তেমনি এটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কীভাবে নেপালের নদী ও বনভূমি হুমকির মুখে পড়ছে। উটচরের মতো সংবেদনশীল প্রাণীর টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন পরিষ্কার জল, মাছের প্রাচুর্য ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু বর্তমানে নেপালের অনেক নদীই দূষণের শিকার।
স্থানীয় পর্যায়ের খনন কাজ নদীতে রাসায়নিক মিশিয়ে দেয়, যার ফলে মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এটি সরাসরি উটচরের খাদ্যশৃঙ্খলে প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি, বনভূমি নিধন ও কৃষিজ রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে নদীর পানিতে বিষাক্ত উপাদান প্রবেশ করছে, যা উটচরের মতো পানিকেন্দ্রিক প্রাণীদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে।
সংরক্ষণের ডাক: এখনই সময় উদ্যোগ নেওয়ার
এই খুদে উটচরের ফিরে আসা কেবল একটি প্রাণীর গল্প নয়, বরং এটি আমাদের দায়বদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। আইইউসিএন উটচর বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠীর হিমালয় অঞ্চল সমন্বয়কারী সঞ্জন থাপা জানান, “এশীয় খুদে উটচরকে জাতীয় সংরক্ষণ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। এখনই পদক্ষেপ না নিলে আমরা আবারও এই প্রাণীটিকে হারিয়ে ফেলতে পারি।”
নেপাল সরকার ইতোমধ্যেই একটি জাতীয় উটচর সংরক্ষণ পরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু করেছে। গবেষক ও পরিবেশকর্মীরা চাইছেন, এই পরিকল্পনায় নতুনভাবে আবিষ্কৃত খুদে উটচরকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক, এবং এর আবাসস্থল রক্ষা নিশ্চিত করা হোক।
প্রকৃতির বিস্ময়: প্রত্যাবর্তনের বার্তা
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির গহীনে এখনও বহু রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। যারা মনে করেন, কোনো প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে গেছে—তাদের জন্য এই উটচরের ফিরে আসা এক বার্তাবাহী অলৌকিকতা। ঠিক যেমনটি এক গবেষকের জীবনে ঘটেছিল, যখন একটি বিরল পাখি বহু বছর পর হঠাৎ তারই বাড়ির পাশে ফিরে এসেছিল।
আপনি কি কখনও এমন কোনো প্রাণীর প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী হয়েছেন, যা বহুদিন ধরে হারিয়ে গিয়েছিল? আপনি নিজ এলাকায় কীভাবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারেন?
এই ছোট্ট উটচরের গল্প আমাদের সবাইকে আহ্বান জানায়—প্রকৃতিকে ভালোবাসুন, রক্ষা করুন এবং প্রকৃতির বিস্ময়গুলোকে জানাতে একসাথে এগিয়ে আসুন।
তথ্যসূত্র: সি এম ইউ