লোক প্রশাসনের প্রকৃতি, পরিধি ও বিষয়বস্তু

ভূমিকা
‘লোক প্রশাসন’ (Public Administration) হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের নীতি, আইন ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয় জনগণের কল্যাণে।
সংক্ষেপে বলা যায় —
লোক প্রশাসন হলো সরকারের “কর্মধারা” (action part of government), যার মূল উদ্দেশ্য হলো “জনকল্যাণ” (Public Welfare)।
এটি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ, নীতি বাস্তবায়ন, ও জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক রক্ষা—এই তিনটি ক্ষেত্রেই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
১. লোক প্রশাসনের প্রকৃতি
লোক প্রশাসনের প্রকৃতি বোঝাতে হলে আগে বুঝতে হবে, এটি একই সঙ্গে একটি প্রয়োগমূলক প্রক্রিয়া (Practical Activity) এবং একটি একাডেমিক শাস্ত্র (Academic Discipline)।
(ক) প্রশাসন একটি কার্যক্রম হিসেবে
- এটি সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্মের প্রয়োগ ক্ষেত্র।
- এখানে সরকারের নীতি, আইন ও বিধান বাস্তবায়িত হয়।
- অর্থাৎ, নীতি প্রণয়ন নয়, বরং নীতিকে কার্যকর করার দায়িত্ব প্রশাসনের।
- উদাহরণস্বরূপ — সরকারি অফিসের কাজ, বাজেট পরিচালনা, জনবল নিয়োগ, আইন বাস্তবায়ন, উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদি সবই লোক প্রশাসনের অংশ।
উদাহরণ:
বাংলাদেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতি নির্ধারণ করে যে “সকল শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হবে” — এই নীতিটি বাস্তবায়ন করার কাজ শিক্ষা অধিদপ্তর, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এটিই প্রশাসনের কার্যকরী দিক।
(খ) প্রশাসন একটি শাস্ত্র হিসেবে
- এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি বিশেষায়িত শাখা।
- এখানে প্রশাসনিক কাঠামো, সংগঠন, নেতৃত্ব, মানবসম্পদ, নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করা হয়।
- এর নিজস্ব তত্ত্ব, নীতি, ও পদ্ধতি আছে।
- এতে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ব্যবস্থাপনা, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্রের প্রভাব বিদ্যমান।
উদাহরণ:
ম্যাক্স ওয়েবারের (Max Weber) “Bureaucracy Theory” বা উড্রো উইলসনের (Woodrow Wilson) “Politics-Administration Dichotomy” — লোক প্রশাসনের তাত্ত্বিক ভিত্তি স্থাপন করেছে।
(গ) লোক প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য
- জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্য — জনগণের প্রয়োজন মেটানো এর মূল লক্ষ্য।
- রাষ্ট্রনির্ভর কার্যক্রম — এটি সরকারের কাঠামোর অংশ।
- সমষ্টিগত চরিত্র — এটি ব্যক্তিগত নয়, বরং দলগত বা প্রাতিষ্ঠানিক কাজ।
- নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া — প্রশাসন কখনো থেমে থাকে না; রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।
- রাজনীতি ও প্রশাসনের সম্পর্ক — নীতিনির্ধারণ (রাজনীতি) ও নীতি বাস্তবায়ন (প্রশাসন) পরস্পর সম্পর্কিত।
- আইন ও বিধি দ্বারা পরিচালিত — প্রশাসনের প্রতিটি কাজ আইনসিদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক।
২. লোক প্রশাসনের পরিধি
লোক প্রশাসনের পরিধি নিয়ে বহু মতভেদ রয়েছে। এর মধ্যে দু’টি প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি বেশি পরিচিত —
(ক) সীমিত বা ব্যবস্থাপনাগত দৃষ্টিভঙ্গি
এই মতের প্রবক্তা লুথার গুলিক (Luther Gulick) ও লিন্ডাল উরউইক (Lyndall Urwick)।
তাঁরা মনে করেন, লোক প্রশাসন কেবল নীতি বাস্তবায়ন ও প্রশাসনিক কাজের দক্ষ ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
তাঁরা একটি সূত্র দেন — POSDCORB, যা প্রশাসনিক কাজের সাতটি মৌলিক ধাপ নির্দেশ করে:
সংক্ষিপ্ত রূপ | পূর্ণরূপ | অর্থ |
---|---|---|
P | Planning | পরিকল্পনা করা |
O | Organizing | সংগঠন তৈরি করা |
S | Staffing | জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ |
D | Directing | নির্দেশনা প্রদান |
CO | Coordinating | সমন্বয় সাধন |
R | Reporting | রিপোর্ট প্রস্তুত ও উপস্থাপন |
B | Budgeting | বাজেট প্রণয়ন ও অর্থ ব্যবস্থাপনা |
অর্থাৎ, তাদের মতে লোক প্রশাসন মানে “নীতি বাস্তবায়নের কৌশলগত প্রক্রিয়া”।
খ) বিস্তৃত বা সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি (Broad or Integral View)
এই মত অনুযায়ী লোক প্রশাসন কেবল নীতি বাস্তবায়ন নয়, বরং নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন — সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করে।
অর্থাৎ, রাজনীতি ও প্রশাসন অবিচ্ছেদ্য।
এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তা — ডুইট ওয়াল্ডো (Dwight Waldo), ফ্রেডরিকসন (Frederickson), প্রমুখ।
(গ) আধুনিক যুগে পরিধির সম্প্রসারণ
বর্তমান সময়ে লোক প্রশাসনের পরিধি আগের তুলনায় অনেক বিস্তৃত হয়েছে। এখন এর অন্তর্ভুক্ত ক্ষেত্রসমূহ হলো:
- নীতিনির্ধারণ (Policy Making)
- নীতিপ্রয়োগ ও বাস্তবায়ন (Implementation)
- জনবল প্রশাসন (Personnel Administration)
- অর্থ ও বাজেট প্রশাসন (Financial Administration)
- উন্নয়ন প্রশাসন (Development Administration)
- জনসম্পর্ক (Public Relations)
- প্রশাসনিক নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা (Ethics & Accountability)
- ই-গভর্নেন্স ও তথ্যপ্রযুক্তি (E-Governance & ICT)
- তুলনামূলক প্রশাসন (Comparative Public Administration)
- স্থানীয় সরকার প্রশাসন (Local Government Administration)
৩. লোক প্রশাসনের বিষয়বস্তু
লোক প্রশাসনের বিষয়বস্তু বলতে বোঝানো হয় — এর গবেষণার ক্ষেত্র, অধ্যয়নযোগ্য বিষয় ও কার্যক্ষেত্রসমূহ।
(ক) প্রশাসনিক কাঠামো
- মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি।
- কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ (Centralization & Decentralization)।
- ক্ষমতা ও দায়িত্ব বণ্টন (Delegation of Authority)।
(খ) মানবসম্পদ প্রশাসন
- সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, পেনশন, দক্ষতা মূল্যায়ন।
- কর্মচারীদের নৈতিকতা ও প্রেষণা (Motivation) বিষয়ক অধ্যয়ন।
(গ) অর্থ প্রশাসন
- বাজেট প্রণয়ন, রাজস্ব সংগ্রহ, ব্যয়ের হিসাব, নিরীক্ষা ইত্যাদি।
- অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
(ঘ) নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
- সরকারের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া, প্রশাসনের ভূমিকা, এবং নীতির প্রয়োগ পদ্ধতি।
(ঙ) উন্নয়ন প্রশাসন
- উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন।
- পরিকল্পনা কমিশন, প্রকল্প বাস্তবায়ন অধিদপ্তর ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।
(চ) জনসম্পর্ক ও যোগাযোগ
- জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক দৃঢ় করা।
- প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রকাশ।
(ছ) প্রশাসনিক নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা
- সততা, ন্যায়, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের চর্চা।
- দুর্নীতি প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
- (জ) তুলনামূলক প্রশাসন
- ভিন্ন ভিন্ন দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ।
- যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশের প্রশাসন কাঠামোর পার্থক্য।
(ঝ) স্থানীয় সরকার প্রশাসন
- ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনা।
৪. রাজনীতি ও প্রশাসনের সম্পর্ক
উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) একসময় রাজনীতি ও প্রশাসনকে আলাদা করে দেখেছিলেন (Politics-Administration Dichotomy)।
কিন্তু বর্তমানে এই বিভাজন পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়।
এখন মনে করা হয় —
“নীতি নির্ধারণ করে রাজনীতি, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করে প্রশাসন।”
অর্থাৎ, উভয়ই পরস্পর পরিপূরক।
৫. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লোক প্রশাসন
বাংলাদেশে লোক প্রশাসনের কাঠামো তিনটি স্তরে বিভক্ত:
- কেন্দ্রীয় প্রশাসন — মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, অধিদপ্তর, বোর্ড।
- মাঠ প্রশাসন — বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
- স্থানীয় সরকার — ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ইত্যাদি।
প্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য — উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও জনসেবা।
উপসংহার
লোক প্রশাসন রাষ্ট্রের হৃদযন্ত্রের মতো—এটি ছাড়া রাষ্ট্র কার্যকরভাবে টিকে থাকতে পারে না।
এটি সরকারের নীতি ও জনগণের প্রত্যাশার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে।
সংক্ষেপে বলা যায়:
- প্রকৃতি: এটি একই সঙ্গে একটি প্রয়োগমূলক কর্মক্ষেত্র ও একটি বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র।
- পরিধি: নীতিনির্ধারণ থেকে বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পর্যন্ত রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম।
- বিষয়বস্তু: প্রশাসনিক কাঠামো, মানবসম্পদ, অর্থ, নীতি, নৈতিকতা, উন্নয়ন ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক।