কে এই নোবেল পুরস্কার জয়ী শিমোন সাকাগুচি ?
শিমোন সাকাগুচি: অনাক্রম্যবিজ্ঞানের মূলনীতিতে পরিবর্তনকারী

শিমোন সাকাগুচি একজন জাপানি অনাক্রম্যবিজ্ঞানী যিনি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি মৌলিক রহস্য উন্মোচন করে বৈজ্ঞানিক জগতে স্থায়ী পরিবর্তন এনেছেন। তাঁর প্রধান আবিষ্কার হলো রেগুলেটরি টি কোষ, যা শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিজের টিস্যু বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করা থেকে সক্রিয়ভাবে বিরত রাখে। এই যুগান্তকারী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০২৫ সালে শারীরবিজ্ঞান বা চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা তিনি মেরি ই. ব্রুনকো ও ফ্রেড র্যামসডেলের সাথে যৌথভাবে ভাগ করে নেন।
প্রাথমিক জীবন, শিক্ষা এবং মৌলিক প্রশ্ন
শিমোন সাকাগুচি ১৯৫১ সালে জাপানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা এবং প্রাথমিক গবেষণা কঠোর বৈজ্ঞানিক নিয়মানুবর্তিতা এবং প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্ন করার সাহস দ্বারা চালিত হয়েছিল।
- শিক্ষা জীবন: তিনি কিয়োটো ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৬ সালে এম.ডি. ডিগ্রি এবং ১৯৮৩ সালে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। ডক্টরেট পরবর্তী সময়ে তিনি আমেরিকার জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি -তে কাজ করেন, যা তাঁকে ইমিউনোলজির ক্ষেত্রে গভীর ধারণা অর্জনে সহায়তা করে।
- প্রচলিত ধারণার বাইরে: নব্বইয়ের দশকে অনাক্রম্যবিজ্ঞানের মূল ধারণা ছিল যে, ইমিউন সিস্টেমের আত্ম-সহনশীলতা প্রধানত কেন্দ্রীয় সহনশীলতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ, শরীরের থাইমাস গ্রন্থির ভিতরে যে ইমিউন কোষগুলি ভুল করে নিজের কোষকে আক্রমণ করতে পারে, সেগুলিকে সেখানেই মেরে ফেলা হয়। সাকাগুচি এই ধারণায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর মনে প্রশ্ন ছিল: যদি কোনো ক্ষতিকর কোষ থাইমাস থেকে বেরিয়েও আসে, তবে কেন অধিকাংশ মানুষ তবুও গুরুতর অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হন না? নিশ্চয়ই থাইমাসের বাইরেও একটি সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে।
রেগুলেটরি টি কোষ -এর আবিষ্কার (১৯৯৫)
সাকাগুচির নিরলস কৌতূহল এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁকে এমন এক আবিষ্কারের দিকে নিয়ে যায় যা অনাক্রম্যবিজ্ঞানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করে দেয়।
- অ-আক্রমণকারী কোষের সন্ধান: ১৯৯৫ সালে, তিনি ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালানোর সময় এক ধরণের টি কোষের উপ-শ্রেণী আবিষ্কার করেন। দেখা যায়, এই কোষগুলি কোনো আক্রমণ করে না, বরং অদ্ভুতভাবে অন্য আক্রমণাত্মক টি কোষগুলির কার্যকলাপকে দমন করে। তিনি এই কোষগুলির নাম দেন CD25+ T কোষ (যা পরে রেগুলেটরি টি কোষ বা Tregs নামে পরিচিত হয়)।
- সক্রিয় প্রতিরক্ষার ধারণা: সাকাগুচিই প্রথম প্রস্তাব করেন যে, এই Tregs কোষগুলি হলো পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স -এর প্রধান কারিগর। এরা শরীরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বাইরেও সক্রিয়ভাবে নজরদারি করে এবং যদি কোনো ইমিউন কোষ ভুল করে শরীরের নিজস্ব টিস্যুকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়, তবে Tregs কোষগুলি সেটিকে থামিয়ে দেয়। এক অর্থে, এরা হলো ইমিউন সিস্টেমের ‘শান্তিরক্ষী’ বা ‘সাপ্রেসার কোষ’।
- প্রাথমিক বিরোধিতা: এই আবিষ্কারটি প্রথমে বিজ্ঞান মহলে ব্যাপক বিরোধিতা ও সন্দেহের সম্মুখীন হয়, কারণ কয়েক দশকের পুরোনো ধারণা ছিল ইমিউন সিস্টেম হয় আক্রমণ করবে নয়তো নীরব থাকবে—এরকম সক্রিয় দমন কেউ প্রত্যাশা করেনি। তবে সাকাগুচির ধারাবাহিক প্রমাণ তাঁর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে।
FOXP3 জিনের সাথে সংযোগ স্থাপন
সাকাগুচির আবিষ্কার Tregs কোষগুলির অস্তিত্ব নিশ্চিত করলেও, এই গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলি ঠিক কোন জেনেটিক কোডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় তা অস্পষ্ট ছিল।
- FOXP3-এর ভূমিকা নিশ্চিতকরণ (২০০৩): ২০০১ সালে মেরি ব্রুনকো এবং ফ্রেড র্যামসডেল যখন FOXP3 জিন আবিষ্কার করে এবং দেখান যে এর ত্রুটি অটোইমিউন রোগ সৃষ্টি করে, তখন সাকাগুচি দ্রুত সেই গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি এবং তাঁর দল প্রমাণ করেন যে, FOXP3 জিনটিই হলো Tregs কোষগুলির চূড়ান্ত নির্দেশক বা মাস্টার ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর। Tregs কোষ তৈরি হওয়ার জন্য এই জিনটি অবশ্যই সক্রিয় থাকতে হবে।
- সম্পূর্ণ ধাঁধা: সাকাগুচি, ব্রুনকো এবং র্যামসডেলের সম্মিলিত কাজ অনাক্রম্যবিজ্ঞানের একটি সম্পূর্ণ ধাঁধার সমাধান করে: ব্রুনকো ও র্যামসডেল দেখান ত্রুটিপূর্ণ জিনটি, আর সাকাগুচি দেখান সেই জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কোষটি। এই তিনটি আবিষ্কার একত্রে মানবদেহে আত্ম-সহনশীলতা রক্ষার প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণভাবে উন্মোচন করে।
বর্তমান ভূমিকা ও বৈশ্বিক প্রভাব
শিমোন সাকাগুচি এখনো সক্রিয়ভাবে গবেষণা করছেন এবং তাঁর কাজের প্রভাব বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত।
- বর্তমান পদ: তিনি বর্তমানে জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটি -এর ইমিউনোলজি ফ্রন্টিয়ার রিসার্চ সেন্টার -এর একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
- চিকিৎসাগত প্রয়োগ: Tregs কোষ আবিষ্কারের ফলে বর্তমানে অটোইমিউন রোগ (যেমন: রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, টাইপ-১ ডায়াবেটিস) চিকিৎসার জন্য নতুন থেরাপি তৈরির পথ খুলে গেছে। বিজ্ঞানীরা এখন শরীরের ভেতরে Tregs কোষের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। আবার, ক্যান্সারের ইমিউনোথেরাপিতে এর বিপরীত কৌশল অবলম্বন করা হয়—Tregs কোষগুলি ক্যান্সার কোষকে রক্ষা করতে পারে বলে, চিকিৎসকরা এদের দমন করে ইমিউন সিস্টেমকে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য আরও কার্যকর করে তোলার চেষ্টা করছেন।
শিমোন সাকাগুচির আবিষ্কার অনাক্রম্যবিজ্ঞানকে শুধুমাত্র একটি ‘প্রতিরক্ষা’ ক্ষেত্র থেকে ‘ভারসাম্য রক্ষা’ এবং ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর একটি ক্ষেত্র হিসেবে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাঁর কাজ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে বা তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সরাসরি সহায়ক হয়েছে।