কে এই নোবেল পুরস্কার জয়ী মেরি এলিজাবেথ ব্রুনকো ?
মেরি ই. ব্রুনকো: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার রহস্যভেদী বিজ্ঞানী

মেরি এলিজাবেথ ব্রুনকো একজন বিশ্বখ্যাত মার্কিন আণবিক জীববিজ্ঞানী এবং অনাক্রম্যবিজ্ঞানী । মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কীভাবে নিজের কোষ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ভুল করে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে, সেই মৌলিক প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আবিষ্কারের জন্য তিনি বিশেষ পরিচিত। এই যুগান্তকারী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি তাঁর দুই সহকর্মী ফ্রেড র্যামসডেল এবং শিমোন সাকাগুচি -এর সাথে যৌথভাবে ২০২৫ সালে শারীরবিজ্ঞান বা চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
প্রারম্ভিক জীবন ও কঠোর শিক্ষা
মেরি ই. ব্রুনকো ১৯৬১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন -এর পোর্টল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ ছিল জীব বিজ্ঞান এবং আণবিক জীববিজ্ঞানের মতো গভীর শাখায়।
- স্নাতক ডিগ্রি: তিনি প্রথমে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন থেকে আণবিক ও কোষীয় জীববিজ্ঞান -এ বি.এস. ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
- পিএইচ.ডি. গবেষণা: ব্রুনকো পরবর্তীতে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি -তে আণবিক জীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট স্তরের গবেষণা শুরু করেন এবং ১৯৯১ সালে পিএইচ.ডি. অর্জন করেন। প্রিন্সটনে তাঁর উপদেষ্টা ছিলেন প্রখ্যাত আণবিক জীববিজ্ঞানী ড. শার্লি এম. টিলম্যান। এই সময়ে তাঁর গবেষণা সরাসরি নোবেল বিজয়ী কাজের সাথে সম্পর্কিত না হলেও, তা বিজ্ঞান জগতে তাঁর ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করে। তাঁর ডক্টরেট গবেষণা H19 জিন নিয়ে ছিল, যা তখন ‘আবর্জনা ডিএনএ’ হিসেবে বিবেচিত হতো। তাঁর কাজ পরবর্তীতে জেনোমিক ইমপ্রিন্টিং—অর্থাৎ একটি জিন মা বা বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হওয়ার ওপর নির্ভর করে কীভাবে বন্ধ বা চালু হতে পারে—সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াটি বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল।
বায়োটেক শিল্পে কর্মজীবন ও ‘স্কার্ফি’ ইঁদুরের রহস্যভেদ
ডক্টরেট সম্পন্ন করার পর মেরি ব্রুনকো সরাসরি শিক্ষাক্ষেত্রে না গিয়ে বায়োটেক শিল্পে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন, যেখানে তাঁর কাজ ছিল গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে মানব কল্যাণে প্রয়োগ করা।
- সেলটেক আরঅ্যান্ডডি: তিনি ওয়াশিংটনের বোথেল-এ অবস্থিত সেলটেক আরঅ্যান্ডডি-তে প্রায় এক দশক কাজ করেন। তাঁর নোবেল বিজয়ী আবিষ্কারের কাজটি এখানেই হয়েছিল।
- ‘স্কার্ফি’ ইঁদুরের অধ্যয়ন: এই সময়ে তিনি ইঁদুরের একটি বিশেষ প্রজাতির ওপর গবেষণা করছিলেন, যা স্কার্ফি নামে পরিচিত। এই ইঁদুরগুলি অল্প বয়সেই মারাত্মক অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেত। মেরি ব্রুনকো এবং তাঁর সহকর্মী ফ্রেড র্যামসডেল একটি পদ্ধতিগত, কঠোর ও দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে এই ইঁদুরের রোগের জেনেটিক কারণ অনুসন্ধান শুরু করেন। সেসময় জিন ম্যাপিং আজকের মতো সহজলভ্য ছিল না, ফলে এই কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ।
- FOXP3 জিনের যুগান্তকারী আবিষ্কার (২০০১): বহু বছর ধরে নিরলস কাজ করার পর তাঁরা আবিষ্কার করেন যে, এই মারাত্মক রোগের মূল কারণ একটি পূর্বে অজানা জিনের মিউটেশন। এই জিনটির নাম দেওয়া হয় FOXP3। তাঁরা নিশ্চিত করেন যে, এই মিউটেশন ইমিউন সিস্টেমের নিয়ন্ত্রক কোষগুলিকে অকার্যকর করে দেয়। তাঁরা দ্রুত দেখান যে, FOXP3 জিনের সমতুল্য ত্রুটি মানুষের মধ্যে IPEX সিন্ড্রোম নামক বিরল ও প্রাণঘাতী অটোইমিউন রোগ সৃষ্টি করে।
- গুরুত্ব: তাঁদের এই আবিষ্কারটিই প্রথম প্রমাণ করে যে, FOXP3 জিন হলো রেগুলেটরি টি কোষ -এর গঠন এবং কার্যকারিতার জন্য একটি অপরিহার্য ‘মাস্টার সুইচ’।
রেগুলেটরি টি কোষ এবং পেরিফেরাল টলারেন্সের ভিত্তি
মেরি ব্রুনকো এবং ফ্রেড র্যামসডেলের এই আবিষ্কার অনাক্রম্যবিজ্ঞানের একটি নতুন অধ্যায় খুলে দেয়।
- শিমোন সাকাগুচির সংযোগ: জাপানি বিজ্ঞানী শিমোন সাকাগুচি এর আগে রেগুলেটরি টি কোষ-এর অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন (১৯৯৫)। ব্রুনকো ও র্যামসডেলের কাজের দুই বছর পর সাকাগুচি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেন যে, FOXP3 জিনটিই সেই রেগুলেটরি টি কোষগুলির জন্ম ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
- ‘পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স’ : এই ত্রয়ীর কাজ সম্মিলিতভাবে একটি সম্পূর্ণ নতুন গবেষণা ক্ষেত্রের ভিত্তি তৈরি করে, যা বর্ণনা করে কীভাবে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরের কেন্দ্রীয় অঙ্গ (থাইমাস) ছাড়িয়ে পেরিফেরাল টিস্যুতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ভুলবশত শরীরের অঙ্গ আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে। এই প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলেই অটোইমিউন রোগ হয়।
বর্তমান ভূমিকা ও অবদান
মেরি ব্রুনকোর কর্মজীবনের দ্বিতীয় পর্যায় প্রধানত গবেষণার নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনার ওপর কেন্দ্রীভূত।
- ইনস্টিটিউট ফর সিস্টেমস বায়োলজি : তিনি বর্তমানে সিয়াটেল-এর ইনস্টিটিউট ফর সিস্টেমস বায়োলজি-তে সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত।
- সিস্টেমস বায়োলজি: এই সংস্থায় তাঁর কাজ মূলত সিস্টেমস বায়োলজি পদ্ধতি প্রয়োগ করে জটিল রোগগুলি অধ্যয়ন করা। তিনি লাইম রোগ , সেপসিস বায়োমার্কার, ফ্যামিলি জিনোমিক্স এবং মাল্টিওমিকস (একসাথে একাধিক জৈবিক তথ্য বিশ্লেষণ)—এর মতো বড় মাপের গবেষণামূলক প্রোগ্রামের নেতৃত্ব দেন।
- চিকিৎসায় প্রভাব: ব্রুনকোর আবিষ্কার শুধু মৌলিক জ্ঞানই বাড়ায়নি, বরং ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপি, অটোইমিউন রোগের চিকিৎসা এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে আরও সফল করার জন্য নতুন কৌশল ও থেরাপির বিকাশে সরাসরি অবদান রেখেছে।
মেরি ই. ব্রুনকো একজন স্থির, অধ্যবসায়ী এবং কৌশলী বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত, যাঁর নীরব কিন্তু গভীর গবেষণা মানব স্বাস্থ্য এবং বিজ্ঞানের ওপর এক বিশাল প্রভাব ফেলেছে।