ভারত-পাকিস্তান সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত: দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন সংঘাতের আশঙ্কা

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের প্রেক্ষাপটে সিন্ধু নদী ও এর শাখানদীগুলোর মানচিত্র, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের জলবন্টন নির্ভরতা দেখানো হয়েছে; নদীর প্রবাহপথ ও সীমান্ত অঞ্চলের ভৌগোলিক চিত্র।
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশঃ এপ্রিল 26, 2025 8:02 অপরাহ্ন

ভারত ক্রস-বর্ডার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক সিন্ধু পানি চুক্তি (Indus Water Treaty) স্থগিত করেছে। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনার একমাত্র কার্যকর সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করা এই চুক্তি সাম্প্রতিক কাশ্মীর হামলার পর একতরফাভাবে স্থগিত করার ঘোষণা দেয় ভারত।

ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যতদিন না পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করবে, ততদিন এই চুক্তি কার্যকর থাকবে না। এই পদক্ষেপের ফলে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এটি ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর সিন্ধু নদীর জলবণ্টন ইস্যু দুই দেশের মধ্যে এক জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৪৮ সালে ভারত যখন একতরফাভাবে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, তখন দুই দেশ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে সিন্ধু পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির আওতায় রবি, শতদ্রু ও বিয়াস নদীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায় ভারত এবং ঝিলাম, চেনাব ও সিন্ধু নদীর অধিকার পায় পাকিস্তান। তবে ভারত পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলো থেকে সীমিত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ পেয়েছিল।

চুক্তির শর্তানুযায়ী, কোনো পক্ষ একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করতে পারত না, বরং কোনো পরিবর্তনের জন্য উভয় পক্ষের সম্মতির প্রয়োজন ছিল। পূর্বে ২০১৬ সালে উরি হামলা ও ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর ভারত চুক্তি পুনর্বিবেচনার কথা বললেও, এবারই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়।

সম্ভাব্য প্রভাব:

বিশ্লেষকদের মতে, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত হলে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে পাকিস্তান। দেশটির ৮০% কৃষি জমি সিন্ধু নদীর পানির উপর নির্ভরশীল। পানির প্রবাহ কমে গেলে খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, যার ফলে পাকিস্তানের জিডিপি — যার ২৫% কৃষিখাত থেকে আসে — বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। পাশাপাশি, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানীয় জলের সংকটও দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে।

এই সংকটের ফলে পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সদস্য সংগ্রহ সহজ হতে পারে, যা পুরো অঞ্চলের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করবে।

অন্যদিকে, ভারতের ক্ষেত্রেও এই পদক্ষেপের পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। জম্মু-কাশ্মীর এবং হিমাচল প্রদেশের নদী অববাহিকায় জলাবদ্ধতা, মরুকরণ এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক মহলে ভারতকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের মুখোমুখি হতে হতে পারে এবং বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের কূটনৈতিক চাপের সম্মুখীন হতে পারে।

আঞ্চলিক পরিণতি:

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার মতো পানিসম্পদ সংকটাপন্ন অঞ্চলে এই ধরনের পদক্ষেপ সামগ্রিকভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে আরও দুর্বল করে তুলবে। পাকিস্তান এবং চীন সম্ভাব্যভাবে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে নতুন সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

বিশ্বব্যাংক পূর্বেই সতর্ক করেছিল, ২০৪০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় পানির সংকটের কারণে বড় আকারের সংঘাত দেখা দিতে পারে। সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিল হলে এই সংঘাতের মাত্রা দ্রুত বাড়তে পারে এবং পুরো অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়তে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, সিন্ধু পানি চুক্তির স্থগিতকরণ শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই এক অশনি সংকেত।

0%
0%
0%
0%