বিএনপির শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে উচ্চ পর্যায়ে কড়া অবস্থান

বিএনপি নেতাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশঃ মার্চ 23, 2025 4:18 পূর্বাহ্ন

বিএনপির শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে উচ্চ পর্যায়ে কড়া অবস্থান সেন্ট্রাল বিএনপি নেতারা বলেছেন, দলের কিছু সদস্যের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের রিপোর্টে তারা বিব্রত এবং এসব কর্মকাণ্ড রোধে আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হবে।

৮ মার্চ, চুয়াডাঙ্গা পৌর বিএনপির ৩ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম সোহেলকে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। চুয়াডাঙ্গা পৌর বিএনপির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মনি এবং সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক পল্টু এই বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। চাঁদাবাজি, বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং শৃঙ্খলাভঙ্গমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে।

ঠিক দুই দিন পর, ১০ মার্চ, সিরাজগঞ্জ সদরে আরও দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। তারা বিএনপি নেতা বাবলু মিয়াকে পিটিয়ে তার হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। জেলা বিএনপির যুগ্ম দফতর সম্পাদক শেখ এনামুল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়।

চিঠিতে বলা হয়, কালিয়া হরিপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা তালুকদার এবং তার ভাই বোরহান উদ্দিন তালুকদার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় দলের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে তাদের সব পদ ও প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের তাদের সঙ্গে সকল যোগাযোগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু বিএনপি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলদারির অভিযোগ উঠেছে, যার ফলে বিভিন্ন জায়গায় প্রাণঘাতী ঘটনাও ঘটেছে। এসব কর্মকাণ্ড দলের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ণ করেছে। কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতারা জানান, নির্বাচনের আগে এমন কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে আরও কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে।

একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, “যেকোনো স্তরের নেতার বিরুদ্ধে যদি দলের বদনাম বা নির্বাচনে প্রভাব ফেলার মতো কোনো ঘটনার প্রমাণ মেলে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এই অপরাধগুলোর মধ্যে ভূমি দখল এখন অন্যতম সাধারণ অপরাধ হয়ে উঠেছে। যেমন, নারায়ণগঞ্জের শান্তিনগর কাশিপুর এলাকায় লতিফ রহমান ও জোছনা বেগম নামে এক দম্পতির ৪.১ শতাংশ জমি রয়েছে। গত বছর নভেম্বর মাসে তারা সেখানে নির্মাণকাজ শুরু করলে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা গিয়াসউদ্দিনের লোকজন তাদের ওপর হামলা চালায় এবং গিয়াসউদ্দিনের নাম ভাঙিয়ে হুমকি দেয়। এরপর থেকে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে আছে, যদিও জমির উপর তাদের নামসংবলিত সাইনবোর্ড এখনো রয়েছে। তারা ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, গিয়াসউদ্দিন কম দামে তাদের জমি কিনে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে গিয়াসউদ্দিন কলার পরিচয় জেনে ফোন কেটে দেন এবং আর কোনো কল রিসিভ করেননি।

শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন, দলের কেউ ব্যক্তিগতভাবে কোনো ভুল করলে দলের দায়ভার নয়। অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও তারা জানান। নেতারা আরও বলেন, বিএনপি নানা ধরনের অপপ্রচারের সম্মুখীন হচ্ছে এবং বেশিরভাগ অপরাধে জড়িতরা সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতাদের নিয়ে একটি দল দেশের বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফর করছে, যাতে নেতাকর্মীদের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছে যায়।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর জনগণ একটি সুশৃঙ্খল, দুর্নীতিমুক্ত, দখলমুক্ত ও চাঁদাবাজিমুক্ত দেশ প্রত্যাশা করছে। তবে বিএনপি নিজের নেতাকর্মীদের একের পর এক নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে বিব্রত। মিডিয়ায় একের পর এক অভিযোগ আসছে এবং দলের হাইকমান্ড বারবার কঠোর সতর্কবার্তা দিলেও তৃণমূল নেতাকর্মীরা তা মানছেন না।

বিএনপি হাইকমান্ডের ব্যবস্থা

শীর্ষ বিএনপি নেতারা দলীয় ব্যানারে কিছু নেতার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে হতাশ। বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, এসব ক্যাডাররা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি, দোকান, বাজার দখল, লুটপাট, চাঁদাবাজি এবং প্রতিপক্ষের ওপর হামলার অভিযোগ এসেছে। এসব কর্মকাণ্ড রোধে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ পর্যন্ত শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, যার মধ্যে বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন এবং হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাশেম রয়েছেন।

এর আগে গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন অভিযোগে ১,০২৩ নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়: ৫২৩ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, ৪৩৭ জনকে বহিষ্কার, ২৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত, ৩৫ জনকে সতর্ক করা এবং ৪ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপ দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে—স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব এবং বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যন্ত।

পাবনার এক বিএনপি নেতা বলেন, “বিএনপির মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঢুকে পড়েছে এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তা বাড়ছে। তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ে একের পর এক অপকর্ম করছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। আমরা তাদের কারণে সুষ্ঠু রাজনীতি করতে পারছি না।”

বিএনপি হাইকমান্ড এবং নীতিনির্ধারকরা প্রতিদিন এসব ঘটনার রিপোর্ট পেয়ে বিব্রত এবং ক্ষুব্ধ। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এই নীতি অব্যাহত থাকবে।

গত বছরের ৭ আগস্ট, বিএনপি নতুন পরিস্থিতিতে নয়াপল্টনে তাদের প্রথম সমাবেশ করে। ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা করেন, “এই মুহূর্ত থেকে কোনো হামলা বা বিশৃঙ্খলা বরদাশত করা হবে না। কেউ বিএনপির নাম ব্যবহার করে কোনো অপরাধ করলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে বিধি মোতাবেক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করুন।”

আগস্ট মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিতর্কিত সাদিক এগ্রো সাইটে বিএনপির নামসংবলিত সাইনবোর্ড দেখা যায়। পরে ঢাকা মহানগর উত্তরের বিএনপি সদস্য সচিব আমিনুল হক মোহাম্মদপুরের ওই হাউজিং এলাকায় যান এবং একটি খালের জায়গায় নির্মিত রাজনৈতিক কার্যালয় দেখতে পান। তিনি ওই অফিস ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন; কার্যালয়টিতে সাত মসজিদ হাউজিং ইউনিট বিএনপির সাইনবোর্ড ঝুলানো ছিল।

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর মাদ্রাসা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক অভিযোগ করেন, আগস্ট মাসে তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয় এবং মাছের ঘের থেকে মাছ চুরি করা হয়। কৃষিকাজে ব্যবহৃত সব যন্ত্রপাতি ও পানি তোলার মোটর নিয়ে যাওয়া হয়, এমনকি ঘরের দরজাও ভেঙে ফেলা হয়। তিনি জানান, হামলাকারীরা স্থানীয় যুবদল ও বিএনপির নেতাকর্মী।

এ বিষয়ে যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, তাদের নেতাকর্মীদের কেউ এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে কোনো ছাড় না দিয়ে সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি যোগ করেন, “আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিই।”

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “তারেক রহমানের নির্দেশে, কারো নাম দখলদারির সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেউ বিএনপির নাম ব্যবহার করে দখল ও চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকলে তাদের আমরা বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন থেকে শত শত নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছি এবং অনেকের পদ স্থগিত করা হয়েছে।”

সম্পর্কিত-
0%
0%
0%
0%