ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের বুলিং ও গসিপে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন এক ছাত্রী

“ঘটনাগুলো আমাকে এতটাই তাড়িয়ে বেড়াতো যে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করতো। ক্লাসে যাওয়ার মতো মনোবলও পাইনি। মানুষ যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সরব হলেও, বুলিং আর গসিপের মাধ্যমে যে মানসিক হয়রানি হয়, তার গুরুত্ব খুব একটা দেওয়া হয় না।” — এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী।
২৬ বছর বয়সী ওই তরুণী অভিযোগ করেছেন, স্নাতক অধ্যয়নকালে সহপাঠীদের হাতে তিনি বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো প্রতিকার পাননি। এতটাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন যে, স্নাতক শেষ করেও আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি থাকেননি। বরং চাকরি শুরু করেন এবং সম্প্রতি বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান।
তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ধারাবাহিক বুলিং ও গসিপ তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। এজন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে ছয়-সাতবার কাউন্সেলিং নিতে হয়। কিন্তু তার বিভাগ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি।
‘আমি ওদের সঙ্গে আর পড়ব না’
তরুণী জানান, ২০১৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শুরুতে সবার সঙ্গে মিশতে চাইলেও একটি ‘এলিট’ গ্রুপ তাকে টার্গেট করে। মূলত কিছু ধনী পরিবারের সন্তানরা এই গ্রুপ গঠন করে, যাদের অনেকে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সন্তান।
করোনাকালে ফেসবুকে ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি হয়, আর তখন থেকেই বুলিং শুরু হয়। পোশাক নিয়ে কটূক্তি, সম্পর্ক নিয়ে গসিপ, গুজব রটানো, এমনকি দেহ নিয়ে অশালীন মন্তব্য ও স্পর্শ — এসব হয়রানির শিকার হন তিনি।
একপর্যায়ে মাস্টার্সে ভর্তি হলেও মাত্র দুটি ক্লাস করার পরই তিনি তা ছেড়ে দেন।
তিনি বলেন,
“আমি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম যে আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি। বাবা-মা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আমি ওদের সঙ্গে আর পড়াশোনা করব না।”
শিক্ষকের প্রতিক্রিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক শিক্ষক ও তৎকালীন স্টুডেন্ট কাউন্সেলর জানান, তিনি অভিযুক্তদের ডেকে কথা বলেছেন। তাদের দাবি ছিল, তরুণী আসলে সম্পর্ক ভাঙার কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
শিক্ষক বলেন, “অভিযোগগুলো প্রমাণ করা কঠিন ছিল। তাই তাকে মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে বলেছিলাম।”
তবে ওই ছাত্রী অভিযোগ করেন, মৌখিক অভিযোগ করার সময় গুরুত্ব না দেওয়ায় অভিযুক্তরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পরে তিনি লিখিত অভিযোগ দিলেও তখন অভিযুক্তরা মাস্টার্স শেষ করে ফেলেছিল।
গবেষণায় বুলিংয়ের বাস্তবতা
আচল ফাউন্ডেশনের ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সহপাঠীদের দ্বারা অবমূল্যায়নের কারণে হীনমন্যতায় ভোগেন।
আরেকটি গবেষণা (পোল্যান্ডের মেনেজমেন্ট জার্নাল, ২০২১) বলছে, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বুলিং একটি বাস্তবতা। এতে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ করার সাহস জোগানো, সচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবার ও শিক্ষকদের সহায়তা এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
‘বুলিংয়ের অভিযোগ গুরুত্ব দিতে হবে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক কামাল চৌধুরী বলেন,
“যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেল থাকলেও বুলিং প্রতিরোধের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ বুলিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীরা ভেঙে পড়তে পারে, ক্লাস এড়িয়ে যেতে পারে, অপরাধবোধে ভুগতে পারে, এমনকি আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে পারে। তাই অভিযোগ গুরুত্বসহকারে নিতে হবে।”
তিনি জানান, ঢাবির ছাত্রী হলগুলোতে এবং টিএসসির তৃতীয় তলায় বিনামূল্যে কাউন্সেলিং সুবিধা আছে। তবে তথ্যের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী তা জানেন না। পাশাপাশি নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটে অর্থের বিনিময়ে সেবা পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র: পোল্যান্ডের মেনেজমেন্ট জার্নাল, প্রথম আলো