ইরানে গণশোক: ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, আমজনতার ঢল

ইসরায়েলি হামলায় নিহত প্রায় ৬০ জনের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে ইরানের রাজধানী তেহরানে জড়ো হয়েছেন হাজারো মানুষ। এই স্মরণ অনুষ্ঠানে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানী, নারী ও শিশু সহ বহু সাধারণ নাগরিক। আজকের এ অনুষ্ঠানটিকে ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তেহরানের রাজপথে চলমান এই শোকযাত্রায় এক বিশেষ ট্রাক শিশুদের কফিন বহন করছে, যা অনেক ইরানির জন্য অত্যন্ত আবেগঘন এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ। শিয়া রাজনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে, কারবালার যুদ্ধের সময় ইমাম হুসাইনের সন্তান নিহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে আজকের এই দৃশ্য মিলে যায়, যা শিয়া মতবাদের কেন্দ্রীয় আবেগের অংশ।
শুধু রাজধানী তেহরানেই নয়, একই ধরনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইরানের অন্যান্য শহরেও। সরকার এ অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশের ভেতরে ও বাইরের মানুষের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে চাচ্ছে— ইরানি জাতি ঐক্যবদ্ধ এবং শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল।
বিশেষভাবে আজকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান হোসেইন সালামি, এরোস্পেস কমান্ডার হাজিসাদেহ, শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানী এবং পারা-মিলিটারি গোষ্ঠীর নেতারা। জানা গেছে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৩০ জনেরও বেশি শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং ১১ জনের বেশি পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। বেসামরিক স্থাপনা, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন, এমনকি সামরিক ও গোয়েন্দা সদর দফতর পর্যন্ত এই হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
ইরান এখন একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির মধ্যে রয়েছে এবং সেই সময়ে স্থগিত রাখা রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াগুলো আজ একসঙ্গে সম্পন্ন করা হচ্ছে। উপস্থিত জনতার ঢল ও জনগণের অংশগ্রহণই বোঝায় যে, রাষ্ট্র এই কঠিন সময়ে জনগণের সম্পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছে।
আমেরিকার প্রতি ইরানের হুঁশিয়ারি
এদিকে, পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সম্ভাব্য চুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কড়া বার্তা দিয়েছে ইরান। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ এক পোস্টে বলেন, যদি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সত্যিই সমঝোতায় আগ্রহী হন, তাহলে তাকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রতি “অসম্মানজনক ও অগ্রহণযোগ্য” ভাষা বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, “আয়াতুল্লাহ খামেনিকে অপমান করার অর্থ হচ্ছে বিশ্বের কোটি কোটি শিয়ার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা, যারা তাকে শুধু রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবে মানে।”
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, সর্বোচ্চ নেতা কেবল ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক, সামরিক এবং রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকাও পালন করেন। শিয়া মতবাদের অনুসারে তিনি ১২তম ইমামের প্রতিনিধি এবং ঈশ্বরদত্ত এক ঐশ্বরিক অবস্থানে রয়েছেন। তাই তাকে আক্রমণ করা মানেই ইরানের সমগ্র রাজনৈতিক কাঠামোকে অস্বীকার করা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরমাণু আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আবারও সরাসরি আলোচনা সম্ভব হলেও এর শর্ত হিসেবে খামেনিকে সম্মান জানানো ও তার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি মুখ্য। কারণ, আলোচনা শুরু কিংবা বন্ধ— উভয় সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে রয়েছেন তিনিই।
তবে বর্তমানে তার অবস্থান কোথায়, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। অনেক ইরানি আশঙ্কা করছেন, তার ওপর হামলার আশঙ্কা এখনো কাটেনি, এবং তাকে ঘিরেই এখন পুরো ইরানি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা