কেন ইলন মাস্ক ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ছেড়ে দিলেন?
সরকারি ব্যয় কমাতে নিয়োজিত DOGE প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন এলন মাস্ক, ট্রাম্প প্রশাসনের বাজেট বিল নিয়ে প্রকাশ্যে মতবিরোধ।

ছবি সংগ্রহকৃত
যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের উদ্যোক্তা ও টেসলার প্রধান ইলন মাস্ক (Elon Musk) সরকারি ব্যয় হ্রাসের জন্য গঠিত “Department of Government Efficiency (DOGE)”–এর প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ সরকার উপদেষ্টা হিসেবে নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ায় তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান।
DOGE–এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় মাস্ক সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে কাজ করেছেন। তবে তাঁর বিদায় আসে এমন এক সময়, যখন তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক “One Big Beautiful Bill” নামে পরিচিত বিশাল ট্যাক্স ও ব্যয়সংক্রান্ত বাজেট বিল নিয়ে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে মতবিরোধে জড়ান।
“একটি বিল বড় হতে পারে, সুন্দর হতে পারে — কিন্তু দুটো একসঙ্গে নয়”
এক সাক্ষাৎকারে মাস্ক বলেন, “এই বিশাল বাজেট বিল আমাকে হতাশ করেছে। এতে ঘাটতি আরও বাড়বে এবং আমি DOGE–এ যা করার চেষ্টা করেছি, তার বিরোধী কিছুই এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।”
CBS এর সানডে মর্নিং অনুষ্ঠানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি মনে করি একটি বিল বড় হতে পারে, এটি সুন্দরও হতে পারে, কিন্তু একসঙ্গে দুটো হওয়া কঠিন।”
X–এ বিদায়ী পোস্ট
বুধবার X (সাবেক টুইটার)–এ এক পোস্টে মাস্ক লেখেন:
“বিশেষ সরকার কর্মচারী হিসেবে আমার নির্ধারিত সময় শেষ হয়েছে। আমি প্রেসিডেন্ট @realDonaldTrump–কে কৃতজ্ঞতা জানাই অপচয় কমাতে সুযোগ দেওয়ার জন্য।
@DOGE–এর মিশন সময়ের সঙ্গে আরও শক্তিশালী হবে এবং এটি সরকারি কাজের অংশ হয়ে উঠবে।”
চার মাসেই শেষ হল মেয়াদ
যুক্তরাষ্ট্রের আইনে “Special Government Employee” হিসেবে মাস্ক সর্বোচ্চ ১৩০ দিন সেবা দিতে পারেন প্রতি বছরে। মাস্কের দায়িত্বকাল ছিল চার মাসের একটু বেশি, যা এই সীমার কাছাকাছি।
এপ্রিলেই মাস্ক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে মে মাস থেকে তাঁর সরকারি কাজে সময় দেওয়া কমে আসবে এবং তিনি নিজ ব্যবসা, যেমন স্পেসএক্স ও টেসলায় আবার মনোযোগ দেবেন।
বাজেট বিল নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে মতানৈক্য
বাজেট বিলটি ২২ মে রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে একক ভোটে পাস হয়। বিলটিতে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের কর ছাড় সম্প্রসারিত করার পাশাপাশি ‘ম্যাস ডিপোর্টেশন’ (গণপ্রত্যাবাসন) ও মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্ত নিরাপত্তায় বড় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ট্রাম্প বিলটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানালেও তা কার্যকর রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মাস্কের বিরুদ্ধে বিতর্ক ও সমালোচনা
DOGE প্রধান হিসেবে মাস্ক সরকারি ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে বড় পরিসরে কর্মী ছাঁটাই, সরকারি সংস্থা বন্ধ ও চুক্তি বাতিল করেছেন। বিশেষ করে USAID (যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা সংস্থা)–এর কার্যক্রম প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনের USAID অফিস কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় ১,৬০০ কর্মীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং ৪,৭০০ জনকে ছুটিতে পাঠানো হয়। তাদের মাত্র ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল জিনিসপত্র গুছিয়ে বের হয়ে যাওয়ার জন্য।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের এক ফেডারেল বিচারক রায় দেন যে, DOGE–এর এই কার্যক্রম সম্ভবত সংবিধান লঙ্ঘন করেছে এবং USAID–এর বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ স্থগিত করতে আদেশ দেন।
“বিনাশের মন্ত্র”— সমালোচকদের মন্তব্য
ভোক্তা অধিকার সংগঠন Public Citizen–এর সহসভাপতি লিসা গিলবার্ট বলেন, “DOGE ছিল ধ্বংসের এক মন্ত্র। মাস্কের এই ভূমিকার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মীরা চাকরি হারিয়েছেন, শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ কমেছে এবং জনগণের গোপনতা লঙ্ঘিত হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বব্যাপী এই ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়বে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে।”
চ্যাটাম হাউসের গবেষক ম্যাক্স ইয়োয়েলি বলেন, “DOGE–এর কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সক্ষমতা দুর্বল করেছে এবং গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।”
DOGE–এর ভবিষ্যৎ কী?
DOGE প্রতিষ্ঠা করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি, শপথ নেওয়ার দিনই। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
DOGE–এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক ও পেপারডাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কোলিন গ্রাফি। তিনি বলেন, “DOGE–এর শক্তি এসেছিল বিশ্বের ধনী মানুষ মাস্কের প্রভাব থেকে। তাঁর অনুপস্থিতিতে এবং চলমান মামলার কারণে DOGE টিকে থাকলেও এর আয়ু হয়তো খুব বেশি দিন নয়।”
বিশ্বের অন্যতম আলোচিত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এলন মাস্ক হোয়াইট হাউসে মাত্র চার মাস দায়িত্ব পালন করেই বিদায় নিলেন। তবে এই স্বল্প সময়েই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এক অস্থির অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছেন, যা সম্ভবত ভবিষ্যতের ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে যাবে। DOGE–এর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তবে মাস্কের রেখে যাওয়া বিতর্ক ও সমালোচনার ছায়া থেকে এ সংস্থা সহজে বের হতে পারবে না বলেই ধারণা।