গাজায় শান্তি রক্ষায় নয়, ‘শান্তি বল প্রয়োগে’ কেউ অংশ নেবে না: জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক
সংশোধনঃ 27 অক্টোবর 2025, 07:46 অপরাহ্ন
গাজায় শান্তি রক্ষায় নয়, ‘শান্তি বল প্রয়োগে’ কেউ অংশ নেবে না: জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ

গাজায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে শান্তি বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাবে অনেক দেশ আপত্তি জানাবে বলে সতর্ক করেছেন জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনায় যদি “শান্তি রক্ষা” নয় বরং “শান্তি বল প্রয়োগে”সেনা মোতায়েনের কথা থাকে, তাহলে কোনো দেশই সে ঝুঁকি নিতে চাইবে না।

বিজ্ঞাপন

“কেউ অস্ত্র হাতে গাজায় টহল দিতে যাবে না”

বিবিসি প্যানোরামাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বাদশাহ বলেন, “প্রশ্ন হচ্ছে—গাজায় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা কী হবে? যদি সেটা শান্তি রক্ষা হয়, তাহলে সেটি স্থানীয় ফোর্স, বিশেষত ফিলিস্তিনি পুলিশকে সহায়তা করা—যা আমরা (জর্ডান ও মিসর) বিপুল সংখ্যায় প্রশিক্ষণ দিতে পারি। কিন্তু যদি সেটা শান্তি বল প্রয়োগ হয়, মানে অস্ত্র হাতে টহল দেওয়া—তাহলে কোনো দেশই তাতে যুক্ত হতে চাইবে না।”

তিনি জানান, জর্ডান গাজায় সেনা পাঠাবে না, কারণ দেশটি রাজনৈতিকভাবে ওই সংঘাতের সঙ্গে “অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত”। জর্ডানের অর্ধেকের বেশি জনগণ ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত এবং কয়েক দশক ধরে দেশটি ২৩ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে—যা অঞ্চলটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনায় আরব দেশ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের গাজায় স্থিতিশীলতা বাহিনী পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। এই বাহিনী “ফিলিস্তিনি পুলিশকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেবে” এবং এতে জর্ডান ও মিসরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী হামাসকে নিরস্ত্র হয়ে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে হবে।

বিজ্ঞাপন

তবে হামাস এখনো নিরস্ত্র হয়নি; বরং হাজারো যোদ্ধা মোতায়েন করে তারা গাজার কিছু অংশে প্রভাব বিস্তার করছে। অন্যদিকে ইসরায়েল অব্যাহত রেখেছে বিমান হামলা ও সামরিক অভিযান।

বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেন, “আমি হামাসকে চিনি না, তবে কাতার ও মিসর যারা তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে, তারা বেশ আশাবাদী যে হামাস প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।”

তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, “যদি আমরা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ নেই—না ইসরায়েলিদের জন্য, না ফিলিস্তিনিদের জন্য, না আরব-মুসলিম বিশ্বের জন্য।”

গাজায় মানবিক সহায়তা ও শিশুদের উদ্ধার অভিযান

জর্ডান গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানো ও আহত শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে কাজ করছে। বাদশাহ নিজে তিনবার গাজার আকাশসীমায় উড়ে ত্রাণ সরবরাহ মিশন পরিচালনা করেছেন।

“পেছনের দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলাম—ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নেই,” তিনি বলেন। “ওই দৃশ্য আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, কীভাবে এটি হতে দিচ্ছি—তা ভেবে স্তম্ভিত হয়ে গেছি।”

তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সহায়তায় গাজা থেকে ২ হাজার অসুস্থ শিশু সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানান। ট্রাম্প একে “একটি সুন্দর উদ্যোগ” বলে প্রশংসা করেন। এখন পর্যন্ত ২৫৩ শিশুকে জর্ডানে স্থানান্তর করা হয়েছে, আর মোট ৫ হাজারের বেশি আহত বা অসুস্থ মানুষকে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারে নেওয়া হয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এখনো প্রায় ১৫ হাজার মানুষ, এর মধ্যে ৩ হাজার শিশু, সরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় আছে।

রানী রানিয়ার আবেগঘন সমালোচনা

বিবিসি প্যানোরামারই অংশ হিসেবে জর্ডানের রানী রানিয়া বলেন, “গত দুই বছর ধরে একজন মা হিসেবে যে অনুভূতি আমাদের হচ্ছে—তা বর্ণনাতীত। সন্তানদের কষ্টে দেখা, ক্ষুধায় কাঁপতে দেখা, ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটাতে দেখা—আর কিছুই করতে না পারা। এই দুঃস্বপ্নই এখন প্রতিদিনের বাস্তবতা ফিলিস্তিনি মায়েদের জন্য, অথচ বিশ্ব তাকিয়ে আছে, কিছু করছে না।”

ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত রানিয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভূমিকাকে প্রশংসা করে বলেন, “তার কৃতিত্ব এই যে, তিনি প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলের ওপর প্রকৃত চাপ প্রয়োগ করেছেন। আগে যেসব প্রেসিডেন্টরা কেবল মুখে তিরস্কার করতেন, ট্রাম্প কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে পেরেছেন। আশা করি তিনি এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবেন।”

যুদ্ধ, হতাহতের পরিসংখ্যান ও শান্তির আশার কথা

হামাসের নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলি অভিযানে গাজায় এখন পর্যন্ত ৬৮ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। যুদ্ধের সূত্রপাত হয় ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায়, যেখানে ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে গাজায় আটক করা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইতোমধ্যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্ট এবং নিহত হামাস কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের পরোয়ানা জারি করেছে।

যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে গাজা থেকে ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ইসরায়েল মুক্তি দেয় ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দি এবং গাজা থেকে আটক রাখা ১৭০০ জনকে যারা কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক ছিল।

রানিয়া: “আশা বেছে নেওয়াই প্রতিরোধের এক রূপ”

শেষে রানিয়া বলেন, “আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা পাশাপাশি বসবাস করতে পারে। এখনকার ঘৃণা, ক্রোধ আর হতাশার মধ্যে তা হয়তো অসম্ভব মনে হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পেলে শান্তি সম্ভব। অনেক সময় আশা ধরা কঠিন হয়, তবু সেটাই একমাত্র পথ—যা আমাদের মানবতাকে অস্বীকার করে না।”

তথ্যসূত্র: বিবিসি

0%
0%
0%
0%