গাজায় এখনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে হাজারো জীবন

গাজায় যুদ্ধবিরতি এলেও থেমে নেই মৃত্যু আর বেঁচে থাকার লড়াই। নাসের হাসপাতালের ওয়ার্ডজুড়ে এখন অসহায় অসংখ্য মানুষ— তাদের মধ্যে আছে দুই দশ বছরের শিশু। একজন ইসরায়েলি গুলিতে গলার নিচ থেকে প্যারালাইজড, আরেকজনের মাথায় মারণ টিউমার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গাজায় প্রায় ১৫ হাজার রোগী এখন জরুরি চিকিৎসা ও বিদেশে স্থানান্তরের অপেক্ষায়।
দক্ষিণ গাজার একটি অস্থায়ী তাঁবুতে বসে আছেন ওলা আবু সাঈদ। তাঁর ছেলে আমরকে ইসরায়েলি ড্রোনের গুলিতে আহত হয়ে প্যারালাইসিসে ভুগছে। গুলিটি তার ঘাড়ের হাড়ের মাঝখানে আটকে আছে। চোখে কান্না নিয়ে মা বললেন—
“ওর খুব দ্রুত অস্ত্রোপচার দরকার। কিন্তু ডাক্তাররা বলেছেন, এখন অপারেশন করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মৃত্যু, স্ট্রোক বা রক্তক্ষরণের আশঙ্কা রয়েছে। এমন উন্নত হাসপাতালে ওর চিকিৎসা দরকার, যা গাজায় এখন নেই।”
বিজ্ঞাপন
দুই বছরের যুদ্ধ শেষে গাজার হাসপাতালগুলো প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ওষুধ নেই, যন্ত্রপাতি নেই, বিদ্যুৎ নেই— চিকিৎসা যেন ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া।
অন্য ওয়ার্ডে শুয়ে আছে আরেক শিশু আহমদ আল-জাদ। তার বোন শহদ কাঁদতে কাঁদতে বললেন—
“ও খুব পরিশ্রমী ছিল। যুদ্ধের সময় ঘরে খাবার না থাকলে, ও রাস্তায় পানি বিক্রি করত যাতে কিছু টাকা এনে আমাদের সাহায্য করতে পারে। কয়েক মাস আগে ওর মুখ এক পাশে হেলে পড়তে শুরু করে। আমরা ভেবেছিলাম সাধারণ ব্যথা, কিন্তু পরে ওর ডান হাতও কাজ করা বন্ধ করে দেয়।”
এখন আহমদের মাথায় টিউমার ধরা পড়েছে। বোন শহদ মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন ভাইকে বিদেশে পাঠানোর।
“আমরা ইতিমধ্যে আমাদের বাবা, ঘরবাড়ি আর সব স্বপ্ন হারিয়েছি। আহমদকে হারাতে পারব না। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর সামান্য আশার আলো জেগেছিল— হয়তো একটুখানি সুযোগ মিলবে ওর চিকিৎসার।”
যুদ্ধবিরতির পর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সহায়তায় গাজা থেকে ৪১ জন গুরুতর অসুস্থ রোগী ও তাদের স্বজনদের নিয়ে একটি চিকিৎসা দল দেশ ছাড়তে পেরেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন এখন জর্ডানে চিকিৎসাধীন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এই সংখ্যা যথেষ্ট নয়। হাজার হাজার অসুস্থ মানুষ চিকিৎসার অপেক্ষায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটি চায়, গাজার রাফা সীমান্ত আবার খুলে দেওয়া হোক যেন মিশরের মাধ্যমে রোগীদের বাইরে নেওয়া যায়।
কিন্তু ইসরায়েল বলেছে, যুদ্ধবিরতির শর্ত পূরণ না করা পর্যন্ত রাফা সীমান্ত বন্ধ থাকবে। তারা চায় হামাস নিহত জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দিক। মে মাসে ইসরায়েল ওই সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে তা বন্ধ রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ড. টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস বলেন—
“সবচেয়ে কার্যকর হবে যদি গাজার রোগীদের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়, যেমনটা যুদ্ধের আগে ছিল।”
জেরুজালেমের অগাস্টা ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের পরিচালক ড. ফাদি আতরাশ বলেন—
“আমরা প্রতিদিন অন্তত ৫০ জন ক্যান্সার রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারি। আমাদের কাছে গাজার অনেক রোগীর পুরনো চিকিৎসার নথিও আছে। এ পথটাই সবচেয়ে দ্রুত ও কার্যকর।”
কিন্তু ইসরায়েলের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং তারা কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
হামাসের ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরায়েল নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গাজার রোগীদের পশ্চিম তীরে যেতে নিষেধ করেছে। তাদের দাবি, সেই হামলায় হামাস এরেজ সীমান্তে আক্রমণ করেছিল, যা গাজার মূল প্রবেশদ্বার।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট পর্যন্ত চিকিৎসার অপেক্ষায় কমপক্ষে ৭৪০ জন মানুষ মারা গেছে, যাদের মধ্যে প্রায় ১৪০ জন শিশু।
নাসের হাসপাতালের শিশু ও মাতৃ বিভাগীয় প্রধান ড. আহমেদ আল-ফাররা বলেন—
“একজন চিকিৎসক হিসেবে সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে রোগ চিনে ফেলা, কিন্তু কিছুই করতে না পারা। প্রতিদিনই রোগীদের হারাতে হচ্ছে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকার কারণে।”
গত সপ্তাহে হাসপাতালের আঙিনায় কয়েকটি শিশুর জানাজা হয়—
আট বছরের সা’দি আবু তাহা মারা গেছে অন্ত্রের ক্যান্সারে,
তিন বছরের জাইন তাফেশ ও আট বছরের লুয়াই দুইক মারা গেছে হেপাটাইটিসে।
যুদ্ধবিরতির পরও গাজার শিশুদের জীবনে শান্তি নেই।
যদি দ্রুত উদ্যোগ না নেওয়া হয়, আরও অনেক নিরীহ প্রাণ নিঃশেষ হয়ে যাবে— জীবনের আলো পৌঁছানোর আগেই।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
