গাজায় মানবিক সহায়তা সহজ করার নির্দেশ আইসিজের — ইসরায়েলের প্রতি আন্তর্জাতিক আদালতের কঠোর বার্তা
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বলেছে, দখলদার শক্তি হিসেবে গাজায় ফিলিস্তিনিদের “বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা” পূরণের দায়িত্ব ইসরায়েলের; জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর ত্রাণ কার্যক্রমে বাধা না দেওয়ার নির্দেশ।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) বুধবার জানিয়েছে, ইসরায়েল গাজার ভেতরে মানবিক সহায়তা প্রবাহ সহজ করার জন্য বাধ্য এবং ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় “মৌলিক চাহিদা” নিশ্চিত করতে হবে।
ইসরায়েলের কঠোর প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও এই রায়টি এসেছে এমন এক সময়ে, যখন বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির সুযোগে গাজায় জরুরি সহায়তা পাঠানোর চেষ্টা করছে।
জাতিসংঘের এই শীর্ষ আদালতের “পরামর্শমূলক মতামত” আইনি দিক থেকে বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু আইসিজে বলেছে এটি “গুরুত্বপূর্ণ আইনি ও নৈতিক প্রভাব” বহন করে।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেন, “এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আমি আশা করি ইসরায়েল তা মেনে চলবে।”
আইসিজে প্রেসিডেন্ট ইউজি ইওয়াসাওয়া বলেন, ইসরায়েল জাতিসংঘ ও তার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রমে “সহযোগিতা ও অনুমোদন” দিতে বাধ্য। এর মধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-ও রয়েছে, যাকে ইসরায়েল নিষিদ্ধ করেছে, অভিযোগ তুলে যে সংস্থার কিছু কর্মী ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় যুক্ত ছিল।
তবে আদালত জানায়, ইসরায়েল এসব অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারেনি।
ইসরায়েল এই শুনানিতে অংশ নেয়নি এবং রায়কে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “ইসরায়েল আইসিজের এই ‘পরামর্শমূলক মতামত’ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। এটি শুরু থেকেই রাজনৈতিকভাবে প্রণোদিত এবং আন্তর্জাতিক আইনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের একটি চেষ্টা।”
অন্য এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেন, “ইসরায়েল গাজা বিষয়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে, কিন্তু ইউএনআরডব্লিউএর সঙ্গে কোনোভাবেই কাজ করবে না।”
রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নরওয়ে জানায়, তারা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করবে যাতে ইসরায়েলকে গাজায় ত্রাণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বলা হয়।
ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি আম্মার হিজাজি বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন দায়িত্ব ইসরায়েলকে এই রায়ের প্রতি বাধ্য করা এবং গাজায় সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিত করা।”
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মুখপাত্র আবির ইতেফা জানান, অক্টোবরের ১০ তারিখ থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর ৫৩০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে, যা দুই সপ্তাহে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা দিয়েছে।
তবে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৭৫০ টন খাদ্য যাচ্ছে, যা ডব্লিউএফপির লক্ষ্য (২,০০০ টন প্রতিদিন)-এর চেয়ে অনেক কম।
আইসিজে বলেছে, দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের দায়িত্ব “স্থানীয় জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা, যার মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত।”
একই সঙ্গে আদালত স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, “ক্ষুধাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ।”
জাতিসংঘ আদালতকে অনুরোধ করেছিল ইসরায়েলের এই বাধ্যবাধকতাগুলো পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে—যাতে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা ফিলিস্তিনিদের জন্য জরুরি সহায়তা নিরবচ্ছিন্নভাবে পৌঁছাতে পারে।
গত এপ্রিল মাসে আদালতে এক সপ্তাহের শুনানিতে বহু দেশ ও সংস্থা অংশ নেয়, যেখানে প্রধান বিতর্ক ছিল ইউএনআরডব্লিউএর ভূমিকা নিয়ে।
মার্কিন প্রতিনিধি জশ সিমন্স আদালতে বলেন, “ইউএনআরডব্লিউএ পক্ষপাতদুষ্ট এবং হামাস এর সুবিধা নেয়।” তবে আদালত জানায়, “ইউএনআরডব্লিউএর বিকল্প তৎক্ষণাৎ তৈরি করা সম্ভব নয়, কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া।”
হিজাজি বলেন, ইসরায়েল মানবিক সহায়তাকে “যুদ্ধের অস্ত্র” হিসেবে ব্যবহার করছে, যার ফলে গাজায় অনাহার দেখা দিয়েছে।
এটি গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলমান অন্য মামলাগুলোর থেকে আলাদা।
এর আগে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে আইসিজে ঘোষণা দিয়েছিল, ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল “অবৈধ” এবং তা “যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে।”
বর্তমানে আদালত দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলাটিও বিবেচনা করছে, যেখানে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, গাজায় অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েল ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। একইসঙ্গে হামাস নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারি করা হয়, যিনি ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন।
