মিয়ানমারে সামরিক পুনরুত্থান
কিয়াউকমে পুনর্দখলের মাধ্যমে জান্তার শক্তি ফেরার ইঙ্গিতচীনের সমর্থনে বিদ্রোহীদের পিছু হটা, তীব্র লড়াইয়ে বিধ্বস্ত পাহাড়ি অঞ্চল

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের ছোট্ট শহর কিয়াউকমে দখল করতে গত বছর বিদ্রোহীদের কয়েক মাস লেগেছিল। কিন্তু এ বছর সেনাবাহিনী মাত্র তিন সপ্তাহেই শহরটি পুনর্দখল করেছে।
এই ঘটনাটি স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে—মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধে এখন পাল্লা আবারও সেনা জান্তার দিকে ঝুঁকেছে।
কিয়াউকমের যুদ্ধ ও বিধ্বস্ত শহর
চীনের সীমান্ত থেকে দেশের মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার প্রধান বাণিজ্যপথে অবস্থিত কিয়াউকমে শহরটি তাআং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)-এর জন্য ছিল প্রতীকী বিজয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিখ্যাত “বার্মা রোড” নামে পরিচিত এ পথটি কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু শহরটির নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগে সেনাবাহিনীর টানা বিমান হামলায় শহরের বড় অংশই মাটির সঙ্গে মিশে যায়। দৈনিক হামলায় ৫০০ পাউন্ড ওজনের বোমা ফেলা হয়, পাশাপাশি আর্টিলারি ও ড্রোন হামলায় টিএনএলএর অবস্থানগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশিরভাগই পালিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও এখন কেউ কেউ ফিরতে শুরু করেছেন।
টিএনএলএর মুখপাত্র তার পার্ন লা জানান, “প্রতিদিনই কিয়াউকমে ও হিসপাও এলাকায় ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। এ বছর সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বেড়েছে, তাদের কাছে ভারী অস্ত্র ও বিমানশক্তি রয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি হিসপাও রক্ষা করতে।”
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হিসপাওও সেনাদের দখলে চলে যায়।
চীনের ভূমিকা ও জান্তার অগ্রগতি
পর্যবেক্ষকদের মতে, বিদ্রোহী শক্তিগুলোর এই পতনের প্রধান কারণ চীনের পূর্ণ সমর্থন জান্তার দিকে ঝুঁকে যাওয়া।
বেইজিং ডিসেম্বর মাসে জান্তার ঘোষিত নির্বাচনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করছে—যে নির্বাচন থেকে আং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি-কে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তবে দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধ চলায় নির্বাচনের আয়োজন কতটা সম্ভব, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
সেনাবাহিনী বর্তমানে হারানো অঞ্চলগুলো পুনর্দখলে মরিয়া, যাতে নির্বাচনের আয়োজন করা যায়।
তারা নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করছে—বিশেষত চীনা তৈরি ড্রোন ও জ্যামিং সিস্টেম, এমনকি মোটরচালিত প্যারাগ্লাইডার ব্যবহার করে আকাশ থেকে নিখুঁতভাবে বোমা বর্ষণ করছে।
ফলে এ বছর হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দুর্বল ও বিভক্ত প্রতিরোধশক্তি
অন্যদিকে, সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী জোটগুলো এখন ভেতর থেকেই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় তরুণদের গঠিত শতাধিক জনগণের প্রতিরক্ষা বাহিনী (পিডিএফ) এবং দীর্ঘদিনের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই।
তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হিসেবে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-কে স্বীকৃতি দেয় না।
ফলে এই প্রতিরোধ আন্দোলনের কোনো একক কমান্ড বা কৌশল নেই।
চার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এ গৃহযুদ্ধে হাজারো প্রাণহানি ও লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হলেও, বিদ্রোহীরা এখন ক্রমেই ভূমি হারাচ্ছে।
‘অপারেশন ১০২৭’ ও জান্তার পাল্টা আঘাত
২০২৩ সালের অক্টোবরে শান প্রদেশে তিনটি জাতিগত সেনা সংগঠন মিলে ‘অপারেশন ১০২৭’ চালায়।
তারা কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে ড্রোন ও ভারী আর্টিলারি দিয়ে সেনা ঘাঁটিগুলোর ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়।
ফলস্বরূপ অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় ১৮০টি ঘাঁটি দখল করে নেয় এবং উত্তর শান প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।
তখন ধারণা করা হয়েছিল—সেনা সরকার হয়তো ভেঙে পড়বে।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো; সেনারা হারানো অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করছে এবং তাদের মনোবল ও সক্ষমতা ফিরে পেয়েছে।
বিদ্রোহীদের অস্ত্র সংকট ও চীনের চাপ
চীনের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও দ্বৈত-ব্যবহারের পণ্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বিদ্রোহীদের জন্য ড্রোন বা এর উপাদান সংগ্রহ কঠিন করে তুলেছে।
ড্রোনের দাম বেড়েছে, আর সেনাদের আধুনিক জ্যামিং প্রযুক্তির কারণে অনেক ড্রোন মাঝআকাশেই ধ্বংস হচ্ছে।
অন্যদিকে, ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স-এর আরেক গোষ্ঠী এমএনডিএএ চীনের চাপের মুখে লাশিও শহর ছেড়ে দিয়েছে।
সবচেয়ে শক্তিশালী শান বিদ্রোহী সংগঠন ইউডব্লিউএসএ-ও চীনের নির্দেশে অন্য গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করেছে।
চীনা সীমান্তের প্রবেশাধিকার হারানোর ভয়েই তারা এই নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়েছে।
দক্ষিণ মিয়ানমারে জান্তার পুনর্দখল
কারেন প্রদেশে সেনারা থাইল্যান্ড সীমান্তের প্রধান সড়কটি ফের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন নতুন সৈন্য ও ড্রোনের ব্যবহার এবং স্থানীয় কিছু গোষ্ঠীর “বিশ্বাসঘাতকতা”-কে এর কারণ হিসেবে দিচ্ছে।
তারা এমনকি লেই কে কাও শহরও হারিয়েছে, যা ২০১৫ সালে জাপানের অর্থায়নে শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
কায়াহ প্রদেশে সেনারা দেমোসো ও মোবে শহর পুনর্দখল করেছে, এবং উত্তরাঞ্চলের কাচিন, সাগাইং ও মান্দালে প্রদেশেও অগ্রগতি করছে।
সীমিত সাফল্য ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
তবে দেশজুড়ে জান্তা সর্বত্র সফল নয়।
রাখাইন ও চিন প্রদেশে বিদ্রোহীরা এখনও শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে এবং কিছু এলাকায় সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করছে।
বিশ্লেষক মরগান মাইকেলস মনে করেন, সেনাবাহিনী এখন কৌশলগতভাবে শুধু নির্বাচনী এলাকা ও বাণিজ্যপথগুলোতেই মনোযোগ দিচ্ছে—যেমন কিয়াউকমে ও হিসপাও।
তবে সরকার স্বীকার করেছে যে, ৩৩০টির মধ্যে ৫৬টি টাউনশিপে নির্বাচন করা সম্ভব নয়; বিরোধীরা মনে করছে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে।
চীনের উদ্দেশ্য: “অরাজকতা নয়, স্থিতিশীলতা”
চীন বলেছে, “মিয়ানমারে বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধ আমরা চাই না।”
পর্যবেক্ষকদের মতে, চীন সামরিক জান্তাকে ভালোবাসে না, কিন্তু রাষ্ট্র পতন ঠেকাতে এখন সেটিকেই সমর্থন দিচ্ছে।
চীনের জন্য মিয়ানমার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ—ভারত মহাসাগরে প্রবেশদ্বার, তেল ও গ্যাস সরবরাহের পথ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের জন্য অর্থনৈতিক করিডোর।
তাই বেইজিং এখন নির্বাচনের মাধ্যমে জান্তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ এখন এক জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পরিণত হয়েছে।
চীনের প্রভাব, জান্তার অগ্রগতি এবং বিদ্রোহীদের বিভক্তি—সব মিলিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
যুদ্ধের আগুনে পুড়ে গেছে লক্ষাধিক ঘরবাড়ি, এবং প্রায় প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
রাজনৈতিক সমাধান এখনো দূর—আর শান্তি ফেরানো মিয়ানমারের জন্য এক কঠিনতম লড়াই।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
