এপিকে শীর্ষে শি জিনপিং, যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ অন্যখানে

দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিমান এয়ার ফোর্স ওয়ান উড্ডয়ন করতেই চীন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাঁর হংকি এন-৭০১ লিমুজিনে চড়ে রওনা হন এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশন (এপেক) সম্মেলনের স্থানের উদ্দেশে। প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরের ওই স্থানে পৌঁছে তিনি অংশ নেন বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক বৈঠকে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই দৃশ্যটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। মাত্র ২৪ ঘণ্টার সফর শেষে ট্রাম্প দেশে ফিরলেও শি জিনপিং অবস্থান করছেন এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি ও গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই চেইনের এই অঞ্চলে বর্তমানে প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থায় যে চাপ তৈরি হয়েছে সেটিও এখানে বড় ভূমিকা রাখছে।
বহুপাক্ষিকতা বনাম ‘আমেরিকা ফার্স্ট’
ওয়াশিংটন যখন বাণিজ্য–বাধা ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তিনির্ভর নীতি গ্রহণ করেছে, তখন বেইজিং নিজেকে তুলে ধরছে মুক্ত বাণিজ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে। শি জিনপিং বলেন, “উইটিও–কেন্দ্রিক বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিয়ম–কানুন হালনাগাদ করতে হবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তবে এশিয়ার অনেক দেশই চীনের ভূমিকাকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছে। কারণ, দক্ষিণ চীন সাগরে আগ্রাসী সামরিক অবস্থান, উৎপাদনশিল্পে আধিপত্য এবং বাণিজ্য বিরোধে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণসহ কঠোর নীতির কারণে তারা চীনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান।
এদিকে ট্রাম্পের এপেক সম্মেলন এড়িয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতি জড়তাকে ইঙ্গিত করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ১৯৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মিলিতভাবে এ সংগঠন তৈরির অন্যতম প্রবর্তক ছিল যুক্তরাষ্ট্রই।
দ্বিপাক্ষিক চাপ ও ‘লিবারেশন ডে’ শুল্ক
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি অনুযায়ী, বহু দেশকে এখন কঠিন দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাধ্য করা হচ্ছে। শুল্ক আরোপ ও বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন দেশকে চাপ প্রয়োগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এপেকে অংশ নিয়েছেন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট। পাশাপাশি মার্কিন সিনিয়র কর্মকর্তা কেসি মেস বলেন, “আমাদের উপস্থিতি খুবই শক্তিশালী ও সক্রিয় ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়সূচি মিলেনি বলে সম্পূর্ণ সময় থাকা সম্ভব হয়নি।”
ওয়াশিংটনে ফিরে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে বার্ষিক হ্যালোউইন অনুষ্ঠানেও অংশ নেন।
চীনের কৌশল: আস্থা অর্জনের প্রচেষ্টা
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের নীতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে চীন ধীরে ধীরে আঞ্চলিক কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। সাম্প্রতিক মালয়েশিয়া সফরে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং আসিয়ান সম্মেলনে অংশ নেন এবং আপগ্রেডেড চীন–আসিয়ান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে সই করেন।
এর বিপরীতে ট্রাম্পের ছয় ঘণ্টার আসিয়ান সফরে চারটি বাণিজ্য চুক্তি হলেও সেগুলোতে শুল্ক হ্রাস ছিল না বরং নতুন হুমকির উল্লেখ ছিল। শর্ত ছিল—কোনো দেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের “মূল স্বার্থের বিরুদ্ধে” কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করে তবে তাকে বাড়তি শুল্কের মুখোমুখি হতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই শর্ত আসলে চীনকে লক্ষ্য করেই দেওয়া।
মুক্ত বাণিজ্যের মূল্য ও আঞ্চলিক উদ্বেগ
এপেক শীর্ষ বৈঠকে বড় কোনো নীতিগত সিদ্ধান্তের আশা না থাকলেও শি জিনপিংয়ের উপস্থিতিকে প্রতীকী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীন এখন ধারাবাহিকভাবে আঞ্চলিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দিচ্ছে।
তবে চীনের প্রতি আস্থাহীনতা রয়েই গেছে। বিশেষ করে রেয়ার আর্থস রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর ঘোষণার পর নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বিশ্বব্যাপী। জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তশিহিরো কিতামুরা বলেন, “চীন তাদের সম্পদ ব্যবহার করে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। মুক্ত বাণিজ্যের রক্ষক হিসেবে তারা নিজেদের তুলে ধরছে, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম।”
চীন গ্লোবাল সাউথ প্রজেক্টের এরিক ওল্যান্ডার বলেন, “আঞ্চলিক বাণিজ্য, অবকাঠামো ও সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থার মাধ্যমে চীন এমন অবস্থান তৈরি করছে যাতে ভবিষ্যতে দেশগুলো চীনের ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে না পারে।”
এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার এখন যুক্তরাষ্ট্র–চীন প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে। ট্রাম্প যেখানে স্বল্পমেয়াদি সফর ও শুল্ক নীতিতে মনোযোগী, সেখানে শি জিনপিং দীর্ঘমেয়াদি বহুপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান। তবে দুই শক্তির মধ্যে সন্দেহ–অবিশ্বাস এবং বাণিজ্য–ভূরাজনীতির টানাপোড়েনই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের কূটনৈতিক সমীকরণ কোনদিকে যাবে।
তথ্যসূত্র: রয়টারস
