প্রথম মাসিকের মুহূর্তে পাশে ছিলেন বাবা: সমাজের অচলায়তন ভাঙছেন আধুনিক বাবারা

হেলেনের বয়স তখন মাত্র ১৬। জীবনের প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তার পাশে ছিলেন বাবা জন অ্যাডামস। অনেক পরিবারের মতো মা নয়, সেদিন ঘরে ছিলেন বাবা—আর সেই মুহূর্তটিকে স্বাভাবিক করেই সামলাতে সাহায্য করেছিলেন তিনি।
মাসিক নিয়ে বাবা-মেয়ের আলাপচারিতা অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর মনে হতে পারে। তবে হেলেনের অভিজ্ঞতা ছিল ঠিক উল্টো। কেননা, তার বাবা ছোটবেলা থেকেই মাসিক সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলেছেন।
হেলেন বলেন, “বাবারা হয়তো বলতে পারবেন না মাসিক কেমন লাগে বা কেমন কষ্ট হয়। কিন্তু তারা সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন এবং বিষয়টি নিয়ে নির্ভয়ে কথা বলতে পারেন।”
এখনও অনেক পরিবারে মাসিকের মতো স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ব্যাপারকে লজ্জা আর গোপনীয়তার মধ্যে রাখা হয়। সাধারণত মায়েরাই এই আলোচনার দায়িত্ব নেন। কিন্তু জন অ্যাডামস এই ধারণাকে বদলে দিতে চান।
বাড়িতে সন্তানদের বড় করার সময় তিনি ছিলেন পূর্ণকালীন গৃহস্থ বাবা। তার দুই মেয়ের বয়স এখন ১৬ ও ১২। জন বলেন, “অনেক বাবা-মা বিষয়টি নিয়ে লজ্জা পান এবং স্কুলের উপর দায়িত্ব দিয়ে দেন। কিন্তু এটা শুধু শিক্ষকের দায়িত্ব নয়।”
তার কথায়, “পুরুষরা হয়তো কিছু বিষয়ে অজ্ঞ হতে পারে, কিন্তু তারা বাস্তবভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। আমি স্ত্রী ও মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি, বই পড়েছি, ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়েছি—তারপরই মেয়েদের প্রস্তুত করেছি।”
স্ত্রী হারানোর পর একা বাবার লড়াই
রয় নামে এক বাবা স্ত্রীকে ক্যান্সারে হারানোর পর থেকেই একাই মেয়েকে বড় করছেন। মেয়ের বয়স তখন মাত্র নয়। সেই বয়স থেকেই তিনি বই পড়িয়ে মেয়েকে মাসিক সম্পর্কে জানাতে শুরু করেন।
“প্রথমে ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল,” বলেন তিনি। “কিন্তু আমরা খোলাখুলি কথা বলেছি।” পরে তিনি মেয়েকে দেখান কীভাবে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে হয়, এমনকি পরীক্ষামূলকভাবে পরে দেখার পরামর্শও দেন।
তার মত, “মেয়েকে জীবনের জন্য প্রস্তুত করাই আসল বিষয়। মাসিক, সম্পর্ক, যৌনতা—সবই জীবনের অংশ। এগুলো লুকানো নয়, শেখানোর বিষয়।”
লজ্জা নয়, স্বাস্থ্য সচেতনতা
হানাহ রুটলেজের অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি মাত্র ১০ বছর বয়সে প্রথম মাসিকের সম্মুখীন হন। কিন্তু তার স্কুলে কোনো সঠিক ব্যবস্থা ছিল না—এমনকি ব্যবহৃত প্যাড ফেলার ঝুড়িও ছিল না।
তিনি এখন একটি সামাজিক সংগঠনে কাজ করেন, যারা মাসিক সংক্রান্ত দারিদ্র্য ও সচেতনতা নিয়ে কাজ করে। সংগঠনটি বাবাদের জন্য বিশেষ নির্দেশিকা তৈরি করেছে যেন তারা মেয়েদের সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারেন।
হানাহ বলেন, “বড় কোনো আলাপের জন্য অপেক্ষা না করে ছোট ছোট কথোপকথন দিয়ে শুরু করুন। ঘরে প্রয়োজনীয় উপকরণ রাখুন, সহায়ক হোন।”
তার মতে, ছেলেদের সঙ্গেও মাসিক নিয়ে কথা বলা উচিত। কারণ সমাজ বদলাতে হলে সবাইকে জানাতে হবে।
পরিবর্তনের পথে সমাজ
নারীস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নিঘাত আরিফ জানান, তার ছয় বছর বয়সী ছেলে একদিন বাথরুমে স্যানিটারি সামগ্রী দেখে প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি ব্যাখ্যা করেন, “মা প্রতি মাসে রক্তক্ষরণ করেন, এটা স্বাভাবিক।”
আরও একজন বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিস্টিন একেচি বলেন, “মায়েরা যখন ছেলেদের বয়ঃসন্ধি নিয়ে শিক্ষা দেন, কেউ প্রশ্ন তোলে না। কিন্তু বাবা মেয়েকে মাসিক শেখালে কেন সমস্যা?”
তার মতে, সচেতন বাবা শুধু ঘরেই নয়, কর্মক্ষেত্রেও মাসিক সংক্রান্ত ভুল ধারণা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারেন, যা নারীদের কর্মপরিবেশকে সহায়তা করে।
“সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বাবা-মেয়ের বন্ধন আরও গভীর হয়,” বলেন তিনি।
সমাজ বদলাচ্ছে। মাসিক আর লজ্জার বিষয় নয়—এটি একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে সহযোগিতা করা এখন শুধু মায়েদের কাজ নয়—বাবারাও এর সক্রিয় অংশ।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
