কে এই নোবেল পুরস্কার জয়ী ফ্রেড র্যামসডেল ?
ফ্রেড র্যামসডেল: রেগুলেটরি টি কোষের জেনেটিক কোড উদ্ঘাটক

ফ্রেড র্যামসডেল একজন বিশিষ্ট মার্কিন অনাক্রম্যবিজ্ঞানী এবং আণবিক জীববিজ্ঞানী, যিনি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিজের কোষের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখার প্রক্রিয়া অর্থাৎ পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স -এর একটি প্রধান রহস্য উন্মোচন করেন। বিশেষ করে, তিনি এবং মেরি ই. ব্রুনকো যৌথভাবে FOXP3 জিন আবিষ্কার করেন, যা রেগুলেটরি টি কোষের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। এই যুগান্তকারী কাজের জন্য তিনি, মেরি ই. ব্রুনকো ও শিমোন সাকাগুচি যৌথভাবে ২০২৫ সালে শারীরবিজ্ঞান বা চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
জন্ম ও শিক্ষা
- জন্ম: ফ্রেড র্যামসডেল ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন।
- ডক্টরেট গবেষণা: তিনি ১৯৮৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি গবেষণা ক্ষেত্রে বিশেষ করে অনাক্রম্যবিজ্ঞানের দিকে মনোযোগ দেন।
কর্মজীবন এবং ঐতিহাসিক আবিষ্কারের পটভূমি
ডক্টরেট সম্পন্ন করার পর ফ্রেড র্যামসডেল শিক্ষাজগতের পাশাপাশি বায়োটেকনোলজি শিল্পেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর কর্মজীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে এই শিল্পের গবেষণা ও উন্নয়নে।
- বায়োটেক শিল্পে কাজ: তাঁর নোবেল বিজয়ী আবিষ্কারটি হয়েছিল ওয়াশিংটনের বোথেল-এ অবস্থিত বায়োটেক কোম্পানি সেলটেক আরঅ্যান্ডডি -তে কাজ করার সময়। এখানেই তিনি মেরি ই. ব্রুনকো-এর সাথে সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
- ‘স্কার্ফি’ রোগের রহস্য: র্যামসডেল এবং ব্রুনকো ‘স্কার্ফি’ নামে পরিচিত ইঁদুরের একটি বিশেষ প্রজাতির ওপর নিবিড় গবেষণা শুরু করেন। এই ইঁদুরগুলি তীব্র এবং অনিয়ন্ত্রিত অটোইমিউন রোগ-এর কারণে অল্প বয়সেই মারা যেত। তাঁদের লক্ষ্য ছিল ইমিউন সিস্টেমের এই মারাত্মক ত্রুটির পেছনের জেনেটিক কারণ খুঁজে বের করা।
- FOXP3 জিনের আবিষ্কার (২০০১): অত্যন্ত কঠিন এবং সূক্ষ্ম মলিকিউলার জেনেটিক্স কৌশলের সাহায্যে, র্যামসডেল এবং ব্রুনকো যৌথভাবে FOXP3 নামে একটি নতুন জিনের মিউটেশনকে এই রোগের মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করেন। তাঁরা প্রমাণ করেন যে, এই জিনের ত্রুটির ফলেই ইঁদুরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ হারায়।
- মানব স্বাস্থ্যের সাথে সংযোগ: তাঁরা দ্রুত আবিষ্কার করেন যে, FOXP3 জিনের অনুরূপ ত্রুটি মানুষের মধ্যেও IPEX সিন্ড্রোম নামে পরিচিত একটি বিরল কিন্তু মারাত্মক অটোইমিউন রোগ সৃষ্টি করে। এই রোগটি শিশুদের মধ্যে দেখা যায়, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম বিভিন্ন অঙ্গকে আক্রমণ করে।
রেগুলেটরি টি কোষের নিয়ন্ত্রক হিসেবে FOXP3
র্যামসডেল এবং ব্রুনকোর আবিষ্কার রেগুলেটরি টি কোষের জীববিজ্ঞানে একটি মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।
- মূল ভূমিকা: তাঁদের কাজ নিশ্চিত করে যে, FOXP3 জিনটি একটি ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে এবং এটিই রেগুলেটরি টি কোষের Tregs বিকাশ ও কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য ‘মাস্টার সুইচ’। এই Tregs কোষগুলি হলো ইমিউন সিস্টেমের ‘নিরাপত্তারক্ষী’, যা অন্যান্য আক্রমণাত্মক ইমিউন কোষকে থামিয়ে শরীরের টিস্যুর সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
- অনাক্রম্যবিজ্ঞানে প্রভাব: তাঁদের এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেবল কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়া -ই যথেষ্ট নয়, বরং পেরিফেরাল টলারেন্স নামক একটি সক্রিয় দমন প্রক্রিয়াও অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমান ভূমিকা ও অবদান
ফ্রেড র্যামসডেল তাঁর কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় গবেষণায় কাটানোর পর বর্তমানে বায়োটেক শিল্পে পরামর্শকের ভূমিকা পালন করছেন।
- বর্তমান অবস্থান: তিনি বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক সংস্থা সোনোমা বায়োথেরাপিউটিকস -এর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত। এই সংস্থাটি অটোইমিউন রোগ এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য রেগুলেটরি টি কোষের ওপর ভিত্তি করে নতুন থেরাপি তৈরি করছে।
- চিকিৎসায় অবদান: র্যামসডেল-এর FOXP3 জিনের আবিষ্কার ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপি, অটোইমিউন রোগ (যেমন: ডায়াবেটিস এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস)-এর নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে আরও সফল করার জন্য নতুন গবেষণার পথ উন্মুক্ত করেছে।
ফ্রেড র্যামসডেলের এই আবিষ্কার মলিকিউলার জেনেটিক্স এবং ইমিউনোলজিকে এক করে দেখিয়েছে যে, শরীরের অভ্যন্তরের ক্ষুদ্রতম জেনেটিক ত্রুটি কীভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের ভারসাম্যকে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে, এবং সেই জ্ঞান কীভাবে জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।