শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০ – ১৫ আগস্ট ১৯৭৫), যিনি বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হিসেবে পরিচিত, ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান নেতা ও প্রথম রাষ্ট্রপতি। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান স্থপতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে তিনি সপরিবারে নিহত হন।
পরিচিতি:
নাম: শেখ মুজিবুর রহমান
উপাধি: বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা
জন্ম: ১৭ মার্চ ১৯২০, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত
পিতা: শেখ লুৎফর রহমান
মাতা: সায়েরা খাতুন
ধর্ম: ইসলাম
পেশা: রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, স্বাধীনতা সংগ্রামী
মৃত্যু: ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর, ঢাকা, বাংলাদেশ
সমাধি: বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ
শৈশব
টুঙ্গিপাড়ার নিভৃতপল্লিতে জন্ম নেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেড়ে ওঠা যেমন বর্ণিল, তেমনি চমকপ্রদ। ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নেওয়া ‘খোকা’ ছোটবেলায় ছিলেন দুরন্ত বালক। গ্রামের কাদা-জল, মেঠোপথ আর প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মানবদরদি কিন্তু অধিকার আদায়ে আপসহীন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং তার কন্যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থসহ বিভিন্ন লেখকের গবেষকদের লেখনীতে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে। নানা শেখ আবদুল মজিদ আদরের নাতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান রাখলেও বাবা-মার কাছে ছিলেন ‘খোকা’।
বঙ্গবন্ধু নিজে ‘দুষ্ট বালক’ ছিলেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এমন তথ্য তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতাম।
পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সবার আদর পাওয়ার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, “আব্বার কাছে থেকেই আমি লেখাপড়া করি। আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তাঁর গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসতো না। আমি বংশের বড় ছেলে, তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল।”
কন্যা শেখ হাসিনার এক লেখায় জাতির পিতা এভাবে উঠে এসেছেন, ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে।
বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগতো।
ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তারা তার কথামতো যা বলতেন তাই করতো। এই পোষা পাখি, জীবজন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না।
খেলাধুলা, পাখি ধরা, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো সত্ত্বেও তিনি সে সময় বাড়িতে খুব পড়াশোনাও করতেন। বিশেষ করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তিনি নিয়মিতই পড়তেন। বাড়িতে বাবা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত।
এসবই সে সময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা। সে সময়ের শিক্ষিত পরিবার মাত্রই এসব পত্রিকা বাড়িতে রাখতেন। ছোটবেলা থেকে এসব পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় থাকার কারণে ছোট্ট মুজিবের সামনে বিপুলা পৃথিবীর এক দরাজ দরজা খুলে গিয়েছিল।
কিশোর বয়সে বঙ্গবন্ধু খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না। তবু স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।’
কন্যা শেখ হাসিনার লেখা এবং বিভিন্ন বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর খেলাধুলার তথ্য উঠে এসেছে। তিনি ভালো ফুটবল খেলতেন বলেও শেখ হাসিনা বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন।
পিতা শেখ লুৎফর রহমান অনেক সময় বঙ্গবন্ধুর খেলা দেখতেও যেতেন। হালকা-পাতলা দেহী বঙ্গবন্ধু কখনও বলে লাথি মেরে গড়িয়েও পড়তেন। এসব গল্প শেখ হাসিনার দাদা হাস্যরস করে বাড়িতে বলতেন বলে শেখ হাসিনা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন।
শেখ মুজিব আমার পিতা বইয়ে তিনি লিখেছেন, আমার আব্বার লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লারহাট যেতেন খেলতে।
গোপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। এদিকে আমার দাদাও খেলতে পছন্দ করতেন। আব্বা যখন খেলতেন তখন দাদাও মাঝে মাঝে খেলা দেখতে যেতেন। দাদা আমাদের কাছে গল্প করতেন, ‘তোমার আব্বা এত রোগা ছিল যে বলে জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়তো।
আব্বা যদি ধারে কাছে থাকতেন তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। এর পেছনে মজার ঘটনা হলো মাঝে মাঝে আব্বার টিম ও দাদার টিমের মধ্যেও খেলা হতো।
স্বভাবে দুরন্ত হলেও ছোটবেলায় নানা রোগও তাকে কম ভোগায়নি। শৈশবে বেরিবেরি রোগ হওয়ার পর হৃদযন্ত্র হয়ে পড়েছিল দুর্বল, ১৯৩৬ সালে গ্লুকোমা হওয়ায় চিকিৎসা নিতে হয়েছিল কলকাতায়। অস্ত্রোপচারের পর চোখে উঠেছিল চশমা। চোখের অসুখের কারণে বেশ কিছু দিন পড়াশোনা বন্ধ থাকে। পরে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন তিনি।
যে বয়সটা দুরন্তপনার, সে সময়ই সংসার জীবনে পা রাখতে হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ফজিলাতুন নেছার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন।
আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবো।’
“রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরুব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে।
তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইলো তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাই-বোনদের সাথেই রেণু বড় হয়।
গত শতকের ত্রিশের দশকের মধ্যেই স্বদেশি আন্দোলন দেখে ইংরেজবিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে বালক শেখ মুজিবের মনে।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুর ফিরে এলাম, কোনও কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ।
ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। পরে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ বিভাজনে মুসলিম লীগের প্রতি ঝুঁকে পড়েন শেখ মুজিব। সারা জীবন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির ভক্ত ছিলেন।
গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, মিশনারি স্কুলে পড়াশোনার সময়ই রাজনীতির দীক্ষা হয়ে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের।
ছেলেবেলাতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ তার সারা জীবনেরই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে এটা খুব বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে এলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাঁর নেতৃত্বে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলাপ ওই সময়ই।
“হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাকে সংবর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম।”
ওই আলাপের পর শেখ মুজিবের নাম-ঠিকানা লিখে নেন সোহরাওয়ার্দী। পরে কিশোর মুজিবুর রহমানকে চিঠিও লেখেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। চলে পত্র যোগাযোগ। আর এভাবেই গড়ে ওঠে বাঙালির রাজনৈতিক মঞ্চে গণতন্ত্রের সংগ্রামে গুরু-শিষ্যের এক অনন্য যুগলবন্দি।
ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধু মানবদরদি ও হৃদয়বান ছিলেন। শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘তিনি ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন। তখনকার দিনে ছেলেদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে জায়গীর থেকে পড়াশোনা করতো।
চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসতো। আর সারা দিন অভুক্ত অবস্থায় অনেক দূরে হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। যেহেতু আমাদের বাড়িটা ছিল ব্যাংকপাড়ায়, আব্বা তাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন।
স্কুল থেকে ফিরে দুধ-ভাত খাবার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই তিনি খাবার খেতেন। দাদির কাছে শুনেছি, আব্বার জন্য মাসে কয়েকটি ছাতা কিনতে হতো। কারণ আর কিছুই নয়, কোন ছেলে গরিব, ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ, রোদ বা বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে তাকে ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন।
দাদির কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদি আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দূর থেকে রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড় দেখে সব দিয়ে এসেছেন।’
তিনি যে দরিদ্র মানুষের বিপন্নতায় বিচলিত হতেন, তার প্রমাণ মেলে ছোটবেলার আরেকটি ঘটনায়। ‘একবার তার গ্রামের চাষিদের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষকদের জীবনে নেমে আসে অভাব-অনটন। অনেক বাড়িতেই দুবেলা ভাত রান্না বন্ধ হয়ে যায়।
চাষিদের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা। তাদের সন্তানরা অভুক্ত। সারা গ্রামেই প্রায়-দুর্ভিক্ষাবস্থা নিয়ে চাপা গুঞ্জন। কিশোর মুজিব এরকম পরিস্থিতিতে দুঃখ-ভারাক্রান্ত। কিন্তু কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একটা কিছু করার জন্য তিনি ছটফট করছিলেন। সে সময় যে পথটি তার সামনে খোলা ছিল, তিনি তাই করলেন।
নিজের পিতাকে তিনি তাদের গোলা থেকে বিপন্ন কৃষকদের মধ্যে ধান বিতরণের জন্য অনুরোধ জানালেন। তাদের নিজেদের ধানের মজুত কেমন, এই অনুরোধ তার বাবা রাখতে পারবেন কিনা, সেসব তিনি ভাবেননি। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার চিন্তাটিই ছিল তখন তার কাছে মুখ্য।’
এমন আরও অনেক ঘটনার সমারোহে বঙ্গবন্ধুর শৈশব, কৈশোর কেটেছে। মুজিব তার পূর্ব পুরুষদেরই গড়ে তোলা গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। এ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বাবার কাছে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন।
এর পেছনে একটা ঘটনা আছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘একবার বর্ষাকালে নৌকা করে স্কুল থেকে ফেরার সময় নৌকাডুবি হয়ে যায়। আমার আব্বা খালের পানিতে পড়ে যান। এর পর আমার দাদি তাকে আর ওই স্কুলে যেতে দেননি। আর একরত্তি ছেলে, চোখের মণি, গোটা বংশের আদরের দুলাল, তার এতটুকু কষ্ট যেন সকলেরই কষ্ট!’
বঙ্গবন্ধুর গৃহশিক্ষক ছিলেন আবদুল হামিদ। তিনি গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষা ও অন্যান্য খরচ দিতেন।
ঘুরে ঘুরে জায়গীরও ঠিক করে দিতেন। বঙ্গবন্ধুও তার সহযোগী হিসেবে এসব কাজে যুক্ত ছিলেন। পরে হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই শিক্ষক মারা গেলে বঙ্গবন্ধু নিজেই সেবা সমিতির ভার নেন এবং অনেক দিন পরিচালনা করেন। তিনি ছিলেন ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আরেক শিক্ষক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ কথাগুলো বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছেন।
শিক্ষাজীবন:
৭ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন। মাধ্যমিক স্তরে পড়ার সময় তিনি চোখের দুরারোগ্য বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। এরপর কলকাতায় গিয়ে চোখের অপারেশন করানো হয়। ফলে কয়েক বছর তার পড়াশোনা বন্ধ থাকে।
১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে সুখ্যাত বেকার হোস্টেলে আবাসন গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্র নেতাকে জরিমানা ও বহিস্কার করে। কিন্তু এ অন্যায় আদেশ পালনে তিনি অস্বীকৃতি জানান।
পারিবারিক জীবন:
১৮ বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমান বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে দুই কন্যা—শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তিন পুত্র—শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করেন।
রাজনৈতিক জীবনের সূচনা:
মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। এ বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন মো. শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। তিনি স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবির উপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাদের কাছে যান যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই।
১৯৪৭ সালে মুজিব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যার মাধ্যমে তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন গণ-পরিষদের অধিবেশনে বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই বছরের ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এই সম্মেলনে শেখ মুজিব একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। এখান থেকেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনকালে শেখ মুজিবসহ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে সচিবালয় ভবনের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিব এবং অন্য ছাত্র নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়। ২৩ জুন সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার পর শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন। তাকে দলের পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের শেষে দলের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে আসনে ১৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন। ২৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেয়।
১৯৫৫ সালের ৫ জুন শেখ মুজিব আইন পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। শেখ মুজিব পুনরায় দলের মহাসচিব নির্বাচিত
১৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিয়ে একযোগে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ এবং গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দলের জন্য সম্পূর্ণ সময় ব্যয় করার তাগিদে ১৯৫৭ সালে ৩০ মে মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃতু্যর পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মুজিবের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংহত করার সিদ্ধান্ত হয়।
এই বৈঠকের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শেখ মুজিব তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মহাসচিব ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১১ মার্চ ১৯৬৪ সালে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় যার মাধ্যমে মুজিব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধকল্পে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, রাজনীতির নামে মৌলিক গণতন্ত্র প্রচলন এবং পাকিস্তানের কাঠামোতে এক-ইউনিট পদ্ধতির বিরোধী নেতাদের মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন শেখ মুজিব।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রম্নয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন যা ছিল কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা। ১৯৬৬ সালে মার্চ মাসের এক তারিখে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পর তিনি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রচার কার্য পরিচালনা করেন।
১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব এবং আরও ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সুপরিচিত। এতে শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করা হয় এবং অভিযুক্ত সব আসামিকে ঢাকা সেনানিবাসে অন্ত্যরীণ করে রাখা হয়। এই মামলাকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে সর্বস্তরের মানুষ শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সবার মুক্তির দাবিতে রাজপথে নেমে আসে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গৃহীত হয়। এই সংগ্রাম এক সময় গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণ-আন্দোলনই ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান নামে পরিচিত। মাসব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, কারফিউ, পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং বেশ কিছু হতাহতের পর আন্দোলন চরম রূপ ধারণ করলে পাকিস্তান সরকার ছাড় দিতে বাধ্য হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এক গোলটেবিল বৈঠকের পর এই মামলা প্রত্যাহার করে নেন।
এর সঙ্গে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই বছরের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি তারিখে শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়। উপাধি প্রদানের ঘোষণা দেন তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় মুজিব ঘোষণা করেন এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করা হবে। মুজিবের বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে। মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হন এবং ১৯৭০ সাল নাগাদ কার্যত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো অ্যাসেম্বলি বয়কট করার হুমকি দিয়ে ঘোষণা দেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে তিনি সে সরকারকে মেনে নেবেন না।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ইয়াহিয়া খান সংসদ ডাকতে দেরি করছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এর ফলে বুঝতে পারে, মুজিবের দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেওয়া হবে না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন। ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা চালায়। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তিনি এ ঘোষণা দেন। মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে একদল সামরিক কর্মকর্তার হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হন। তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে থাকার কারণে বেঁচে যান। ২০০৪ সালে বিবিসির সম্পাদিত একটি জরিপে শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিসেবে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত হন।
ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা:
ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তার নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, যা পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত ধর্মঘটে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু কারাবন্দি ছিলেন, তবে জেল থেকেই তিনি আন্দোলনের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন এবং অনশন ধর্মঘট পালন করেন। তার এই অবদান বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অত্যন্ত বিস্তৃত, যা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই দীর্ঘ সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলেছে। তিনি আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতসহ অনেক ভাষা সংগ্রামী জীবন দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যা বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের সংগ্রাম ও অবদানের প্রতিফলন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই আন্দোলন বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার প্রচেষ্টায় ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সংবিধান প্রণীত হয়, যেখানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই অবদান বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশে অপরিসীম। তার নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির স্বার্থ রক্ষায় তিনি ছিলেন আপসহীন। তার এই সংগ্রাম ও ত্যাগের ফলেই আজ আমরা গর্বিতভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি।
ছয় দফা আন্দোলন:
১৯৬৬ সালে তিনি ‘ছয় দফা দাবি’ পেশ করেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছিল। ছয় দফা ছিল:
- পাকিস্তানের ফেডারেল শাসন কাঠামো।
- মুদ্রানীতির স্বায়ত্তশাসন।
- বৈদেশিক বাণিজ্য ও মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ।
- কর আরোপের পূর্ণ ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের হাতে।
- পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক প্যারামিলিটারি বাহিনী।
- পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব রিজার্ভ ব্যাংক ও আর্থিক নীতি।
এই ছয় দফাকে বাঙালিদের মুক্তির সনদ বলা হয়। এতে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং শেখ মুজিবকে বারবার গ্রেফতার করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা:
১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে আবার জেলগেট থেকেই গ্রেপ্তার করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এভাবেই শুরু হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তাকেই করা হয় ১ নম্বর আসামি। তার সঙ্গে আরও ৩৪ জনকে এ মামলার আসামি করা হয়। মামলাটির নাম ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং’ হলেও এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবেই অধিক পরিচিতি পায়। ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে।
তাতে বলা হয়, ‘কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হঠাৎ করে ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি অপর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রেস বিজ্ঞপ্তি পত্রপত্রিকায় পাঠানো হয়।
এতে বলা হয়, গত মাসে পূর্ব পাকিস্তানে জাতিবিরোধী এক পরিকল্পনা উদঘাটিত হয়েছিল এবং সেই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তালিকায় দেখা যায়, এদের মধ্যে দুজন সিএসপি অফিসার ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পিআইএ এবং ইপিআরের লোক ও আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা আছেন।’
(মোনায়েম সরকার সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি’, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ-২০০৮, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-৩৪২)।
আইয়ুব খান চেয়েছিলেন এই মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসাতে। তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে প্রমাণিত করে ফাঁসি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন আইয়ুব-মোনেম গং। কিন্তু আখেরে তারাই ফেঁসে গিয়েছিলেন। এ মামলার জের ধরে পূর্ববাংলায় গড়ে ওঠে প্রবল গণজাগরণ। তাতে আইয়ুব খান ও মোনেম খান গদি ছাড়তে বাধ্য হন। ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
আর শেখ মুজিবুর রহমান জনতার মাঝে ফিরে আসেন আরও বড় হয়ে। আরও প্রবলভাবে। জনতার দেওয়া উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে। গণঅভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে আসে ১৯৭০-এর নির্বাচন। ছয় দফার ওপর গণরায় আসে এই নির্বাচনে। সব মিলিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পূর্ববাংলার রাজনীতিকে আরও বেগবান করে তোলে এবং স্বাধীনতার দাবিকে অনিবার্য করে তোলে।
আবুল মনসুর আহমদ তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘জেনারেল আইয়ুবের সর্বশেষ ও সবচেয়ে আত্মঘাতী ভুল হইয়াছে, তথাকথিত আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা করা। যদি মামলায় বর্ণিত সব বিবরণ সত্যও হইত, তবু আইয়ুব সরকারের এই মামলা পরিচালনা করা উচিত হইত না। দেশরক্ষা বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানি অফিসারদের বিরুদ্ধে সে অবস্থায় বিভাগীয় দ-বিধান করিলেই যথেষ্ট হইত। তা না করিয়া ঢাকঢোল পিটাইয়া পূর্ব পাকিস্তানি অফিসারদের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলা স্বাধীন করিবার অভিযোগে একটা রাজনৈতিক চাঞ্চল্যকর মামলা দায়ের করা হইল।
তার উপর মামলার তদন্তাদিকার্য শেষ করিয়া আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট করিবার পর পূর্ববাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় সর্বাপেক্ষা নির্যাতিত এবং তথাকথিত ঘটনার সময়ের আগাগোড়া জেলখানায় বন্দি, তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুন করিয়া মামলার আসামি তো করা হইলই, এক নম্বর আসামি করা হইল। এই একটি মাত্র ঘটনায় মামলাটির অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ধরা পড়িল।’ (পৃষ্ঠা-৪৭৯)
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র’ শিরোনামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন সাহিদা বেগম। প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পটভূমি তুলে ধরতে গিয়ে সাহিদা বেগম লিখেছেন, লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ববাংলা তো পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রাষ্ট্রই হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু জিন্নাহর চালাকির কারণেই সেটা হলো না। তাই ১৯৪৯ সাল থেকে পূর্ববাংলার মানুষ স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছে। আর এই দাবির পক্ষে মনোজাগতিক ভিত্তি তৈরিতে রাজনীতিক শেখ মুজিবের ভূমিকা এক কথায় অনন্য।
রাজনীতিতে যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুঙ্গে তখনই একজন নৌবাহিনীর তরুণ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন আবেগতাড়িত হয়ে ভিন্নপথে হাঁটার কথা ভাবছিলেন। তিনি দেখছিলেন, ‘পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে সৃষ্ট বেঙ্গল, বালুচ, পাঠান, পাঞ্জাব, এ রকম অনেকগুলো রেজিমেন্ট ছিল। প্রত্যেকে রেজিমেন্টে নিজ নিজ এলাকার লোক থাকত শতকরা ৮০ ভাগ।
রেজিমেন্ট গঠনের ক্ষেত্রেও পশ্চিমা বৈষম্যের ষড়যন্ত্র ছিল চোখে ধাক্কা লাগার মতো। বালুচ পাঠান মিলে ছিল ২০টি রেজিমেন্ট। শুধু পাঞ্জাম রেজিমেন্ট ছিল ৪০টি, সেখানে বাঙালির ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল মাত্র ৪টি।’ (সাহিদা বেগম, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৩)
এ অবস্থায় কজন ক্ষুব্ধ দেশপ্রেমিক বাঙালি অফিসার মিলে গোপনে গড়ে তোলেন ‘বাঙালি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’। করাচির মনোরা দ্বীপে এক অফিসারের বাসায় ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম এসব বিক্ষুব্ধ অফিসারের প্রথম আনুষ্ঠানিক গোপন বৈঠকটি হয়। কমান্ডার মোয়াজ্জেম, স্টুয়ার্ড মুজিব, সিম্যান নুর মোহাম্মদ, লিডিং সিম্যান সুলতানউদ্দিন এই সভাটি করেন।
‘বিদ্রোহীরা বেশিসংখ্যক রেজিমেন্ট গঠনের আশায় সময় কাটাতে রাজি হতে পারল না। তবে বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন তখন অস্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংযোগের বিষয় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করলেন। তিনি ভাবলেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর একটি রাজনৈতিক দলকে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে, নয়তো দেশের ভেতর গণসমর্থনও পাওয়া যাবে না।
তা ছাড়া পাকিস্তান সরকার এটাকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করবে আন্তর্জাতিকভাবে। কমান্ডার মোয়াজ্জেম দলের একজনকে ভার দিলেন মওলানা ভাসানী এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সঙ্গে কথা বলার জন্য।
বিদ্রোহীদের পরিকল্পনার সব বিষয় জানার পর দুই নেতা বিপ্লবী সংগঠনের পক্ষে মত দেন তবে ধীরে এগোনোর পরামর্শও দেন। এমনি করে তারা পূর্ববাংলার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগপ্রধান জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে করাচিতে বিদ্রোহী দলের যোগাযোগ হয়। শেখ মুজিব তখন আইয়ুববিরোধী মোর্চা ন্যাশানাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) প্রচার কাজে করাচি এসেছেন।
বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সঙ্গে আলোচনা করেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে বাঙালিদের ওপর পশ্চিমারা অনবরত অত্যাচার করছে। পশ্চিমীদের এই অত্যাচার এবং পূর্ববাংলার প্রতি সীমাহীন বৈষম্যের কারণে বাঙালি সৈনিকরা পশ্চিম পাকস্তানিদের ওপর প্রচ- ক্ষুব্ধ।
তারা এ থেকে মুক্তি চায়। শেখ মুজিব সঙ্গে সঙ্গে কোনো মতপ্রকাশ করলেন না। কারণ তার বিরুদ্ধে সরকার ডজনখানেক গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছে। এ-ও সরকারের কোনো গুপ্তচর কিনা, শেখ মুজিব ভেবে নিয়ে এক মাস পর জানাবেন বললেন। এক মাস পর কমান্ডার মোয়াজ্জেম ঢাকায় শেখ মুজিবের সঙ্গে আবার দেখা করেন। এর মধ্যে মোয়াজ্জেমের সত্যনিষ্ঠতা এবং দেশপ্রেম সম্পর্কে শেখ মুজিবের গোয়েন্দা বাহিনীর সংবাদে শেখ মুজিব সন্দেহমুক্ত হয়েছেন।’ (সাহিদা বেগম, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৪-১৫)
এর পর শেখ মুজিবের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয় কমান্ডার মোয়াজ্জেমের। এসব বৈঠকে কমান্ডার মোয়াজ্জেম তার পরিকল্পনার খুঁটিনাটি বিষয় উপস্থাপন করেন। শেখ মুজিবকে তিনি জানান, ঢাকাতে যে পরিমাণ পাকিস্তানি আর্মি থাকে কোনো সুযোগে তাদের ওভার পাওয়ার করা সম্ভব। আজীবন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু যে এ ধরনের সামরিক অভিযানের ওপর আস্থাশীল হতে পারেননি সে কথাটি অনন্য গবেষকদেরও দৃষ্টিতে এড়ায়নি।
গবেষক এসএ করিম জানিয়েছেন, শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে বলেছিলেন, মোয়াজ্জেমের এই প্রস্তাব বিষয়ে তিনি জানতেন এবং এই পাগলামি থেকে তার রাজনৈতিক সহযোগীদের দূরে থাকতে বলেছিলেন। কেননা তিনি বরাবরই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ববাংলার মানুষের জন্য স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পক্ষে ছিলেন। (এসএ করিম, শেখ মুজিব : ট্রাইয়াম্পু অ্যান্ড ট্র্যাজেডি, ইউপিএল, ২০০৯, পৃষ্ঠা-১৪২)।
তার নিজের লেখাতেও এই মনোভাবের প্রতিফলন দেখা যায়। কুর্মিটোলাতেই ওই মামলার তদন্তে নিয়োজিত মি. রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবরকে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছেন, ‘আপনারা তো আমার সম্বন্ধে জানেন। আমি তো গোপন ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না।
যাহা ভালো বুঝেছি তাহাই করেছি। স্বায়ত্তশাসনের দাবি তো ১৯৪৯ সাল থেকেই আমি করতে শুরু করেছি। পার্লামেন্টে প্রাদেশিক আইনসভার বাইরে ও ভেতরে আমি প্রচার করেছি। তার পর ছয় দফার প্রস্তাব দিয়েছি ১৯৬৬ সালে। বই ছাপিয়েছি, বক্তৃতা করেছি।’
শেখ মুজিবসহ সব বন্দিকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বন্দি রাখা হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাদের প্রহসনের বিচার চলতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে উকিল নিযুক্ত হয়েছিলেন টমাস উইলিয়াম। ট্রাইব্যুনাল কক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী, কন্যা, পুত্র উপস্থিত থাকতেন।
অন্য অভিযুক্তদের আত্মীয়স্বজনও উপস্থিত থাকতেন। ১৯৬৮ সালের ২০ জুন থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। কক্ষে সাংবাদিকদের বসার জায়গা ছিল। সাংবাদিকরা প্রত্যেক দিনের সাক্ষীর বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। ফলে দেশবাসী মামলার পূর্ণ বিবরণ জানতে পারতেন এবং তারা আইয়ুব-মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন।
এর মধ্যে বিচারাধীন অবস্থাতেই ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ছয়টায় পাকবাহিনীর এক সৈনিক সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফ্লাইট সার্জেট মুহাম্মদ ফজলুর হককে হঠাৎ গুলি করে। গুলিতে নিহত হন জহুরুল হক। শেখ মুজিবকেও হত্যার ষড়যন্ত্র চলছিল। তার আগেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল গণঅভ্যুত্থান। ২০ জানুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ছাত্রনেতা আসাদ। দেশ তখন টগবগ করে ফুটছে। জনগণ রাস্তায় নেমে স্লোগান দিচ্ছিল, জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব…। (সংক্ষিপ্ত)
১৯৭০ সালের নির্বাচন:
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টির বেশি আসন লাভ করে, যা তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করে।
এই নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত হন।
কিন্তু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা অজুহাত দেখাতে থাকেন।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ:
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।
ভাষণে তিনি বলেন:
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এ ভাষণ বাঙালিদের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করে তোলে। এটি আজ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা ঘোষণা:
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে।
শেখ মুজিবুর রহমান ঐ রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
এ সময় তাঁর নেতৃত্ব ও দর্শনই ছিল বাঙালিদের অনুপ্রেরণা।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক:
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দেশ পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
হত্যাকাণ্ড ও মৃত্যু:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনা কর্মকর্তা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
(সংক্ষিপ্ত)