নৌপুলিশের তাড়া খেয়ে নদীতে ঝাঁপ
১৩ দিন পরও নিখোঁজ মনপুরার তরুণ জেলে, মরদেহ ফিরে পেতে মায়ের আর্তনাদ

শরীয়তপুরের জাজিরার কাচিকাটা নদীর ঢেউ এখন যেন শুধু এক মায়ের কান্নায় ভারী হয়ে আছে। ১৩ দিন আগে এই নদীতেই হারিয়ে গেছে মনপুরার তরুণ জেলে মো. আবেদ (২০)। নৌপুলিশের তাড়া খেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল সে। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই তার। প্রতিদিন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মা আর বাবা তাকিয়ে থাকেন পানির দিকে— হয়তো ভেসে উঠবে তাদের ছেলের মরদেহ, অন্তত একবার শেষ দেখা হবে প্রিয় মুখটার সঙ্গে।
নিখোঁজ আবেদ ভোলার মনপুরা উপজেলার ১নং মনপুরা ইউনিয়নের কুলাগাজী তালুক গ্রামের আবুল বাশার মাঝির ছেলে। পরিশ্রমী, হাসিখুশি এই তরুণ জীবিকার তাগিদে মাছ ধরত। নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে তার জীবন চলত প্রতিদিন। কিন্তু সেই নদীই আজ তাকে কেড়ে নিয়েছে— অভিযোগ পরিবারের, নৌপুলিশের তাড়া থেকেই এই মৃত্যুর শুরু।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাঁচ বন্ধু মিলে শরীয়তপুরের জাজিরা অঞ্চলের কাচিকাটা নদীতে হায়ার জালে মাছ শিকার করতে যায় আবেদ। নদীর লালবয়া নামের স্থানে জাল ফেলেই মাছ ধরছিল তারা। ঠিক সেই সময় নদীতে টহলরত নৌপুলিশের একটি টিম তাদের লক্ষ্য করে ধাওয়া দেয়।
পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে জেলেরা জাল ফেলে দ্রুত নৌকা চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। অভিযোগ আছে, তখন নৌপুলিশ তাদের দিকে ছরাগুলি (রাবার বুলেট) ছোড়ে। আতঙ্কিত হয়ে পাঁচজন জেলে নদীতে ঝাঁপ দেন। পরে নৌপুলিশ তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করে। বাকি দু’জন—আবেদ ও মনছুর—নদীর স্রোতে হারিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর আহত অবস্থায় মনছুরকে উদ্ধার করা হলেও আবেদ আর ফিরে আসেনি।
এরপর থেকে নদীর বুক চষে ফিরেছেন বাবা-মা, স্বজনেরা। কিন্তু কিছুই মেলেনি—না কোনো খবর, না কোনো চিহ্ন। শনিবার (২৫ অক্টোবর) পর্যন্ত টানা ১৩ দিন কেটে গেলেও নিখোঁজ রয়েছেন আবেদ।
বাবা আবুল বাশার মাঝি কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন,
“ঘটনার পরপরই শরীয়তপুরের জাজিরা থানায় ও নৌপুলিশের কাছে ছেলের খোঁজে গিয়েছি। কিন্তু কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছি। নিজের টাকায় নদীতে খুঁজেছি, তবুও ছেলের খোঁজ পাইনি। এখন শুধু মরদেহটা পেলেও শান্তি পেতাম।”
এ কথা বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। পাশে বসে থাকা আবেদের মা ছেলের নাম ধরে বারবার ডাকতে থাকেন— “আবেদ রে, তুই নদীতে নামলি কেন রে বাবা… একবার ফিরে আয়, একবার মুখটা দেখ…”
মনপুরা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আহসান কবির বলেন,
“আবেদের বাবা থানায় এসে ঘটনাটি জানিয়েছেন। যেহেতু ঘটনাস্থল জাজিরা এলাকায়, তাই আমরা তাকে জাজিরা থানায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। সেখানে যোগাযোগ রাখা হয়েছে, কোনো খোঁজ পেলে জানানো হবে।”
জাজিরা থানার ওসি মাইনুল ইসলাম জানান,
“ঘটনাটি জাজিরা থানা এলাকায় হলেও নদীপথে হওয়ায় এটি নৌপুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন। নৌপুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে থানায় এ বিষয়ে কোনো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়নি।”
এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও জীবিকার তাগিদে অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে নামেন। কিন্তু পুলিশের তাড়া আর গুলিতে এক তরুণের প্রাণ নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা। তারা দ্রুত নিখোঁজ জেলের সন্ধান ও ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন।
কাচিকাটা নদীর পাড়ে এখন শুধু একটাই প্রতিধ্বনি— “আবেদ রে, তুই কই গেলি রে বাবা…”
