জাজিরায় পদ্মা নদীর ভাঙনে ১ হাজার ৮০০ মিটার তীররক্ষা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষতি প্রায় ৩৫ কোটি টাকা

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পদ্মা নদীর তীররক্ষা বাঁধের প্রায় ১ হাজার ৮০০ মিটার অংশ ভয়াবহ নদীভাঙনে ধসে গেছে। এতে প্রকল্পের প্রায় ৫ লাখ ২৪ হাজার জিওব্যাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) শরীয়তপুর অফিসের তথ্য অনুযায়ী, নদীভাঙনে ২৪টি পরিবার সম্পূর্ণভাবে গৃহহীন হয়েছে এবং প্রায় ৪৫০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত।
বিডব্লিউডিবি শরীয়তপুরের অধীনে পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের জিরোপয়েন্ট এলাকা থেকে সদর ইউনিয়নের পাঠালিয়াকান্দি পর্যন্ত ৮ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে জিরোপয়েন্ট থেকে কথারিয়াকান্দি পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৮০০ মিটার এলাকা তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে। কিছু জায়গায় নদী ভেতরে ১০ থেকে ১১০ মিটার পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ: ধীরগতির কাজেই ক্ষতি বেড়েছে
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলায় এবং সময়মতো কাজ না শুরু করায় ভাঙন রোধ করা যায়নি।
সূত্র জানায়, ওই এলাকায় ১১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১১টি প্যাকেজের আওতায় কাজ করছিল। তারা ৫ লাখ ২৪ হাজার জিওব্যাগ ফেলেছিল, যার অধিকাংশই এখন নদীগর্ভে চলে গেছে।
এই জিওব্যাগ ফেলার কাজের জন্য ঠিকাদাররা ইতিমধ্যেই প্রায় ৩৫ কোটি টাকা বিল উত্তোলন করেছে। পুরো প্রকল্পের বিপরীতে ঠিকাদারদের হাতে মোট ৩১০ কোটি টাকার কাজের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত প্যাকেজগুলোর মধ্যে একটি প্যাকেজের কাজ পেয়েছিল খুলনা শিপইয়ার্ড, যা গত জানুয়ারির শেষে জাজিরার জিরোপয়েন্ট এলাকায় কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু তারা ছয় মাস দেরিতে, জুলাই মাসে কাজ শুরু করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সময়মতো কাজ শুরু না করায় বর্ষাকালে কার্যকরভাবে ভাঙন প্রতিরোধ সম্ভব হয়নি।
ফোনে যোগাযোগ করা হলে খুলনা শিপইয়ার্ডের জেনারেল ম্যানেজার (ডি অ্যান্ড পি) ক্যাপ্টেন এএফএম এনামুল হাসান মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, “লিখিতভাবে প্রশ্ন পাঠালে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) অনুমতি নিয়ে পরবর্তীতে মন্তব্য করা যেতে পারে।”
অন্য এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রাইভেট লিমিটেডের সাইট ইঞ্জিনিয়ার আফতালুন ইসলাম বলেন, “পুরো প্রকল্প এলাকার ১১টি প্যাকেজই ভাঙনের কবলে পড়েছে। প্রচুর উপকরণ নদীতে ভেসে গেছে। আমরা এখন ক্ষতি কমাতে উপকরণ সরিয়ে নিচ্ছি। ভাঙন থামলে এবং বিডব্লিউডিবি নতুন নকশা দিলে আবার কাজ শুরু করা যাবে।”
বিডব্লিউডিবির দাবি: “প্রাকৃতিক ভাঙন”
বিডব্লিউডিবির শরীয়তপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, “এটি মূলত নদীর ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণে হওয়া প্রাকৃতিক ভাঙন। ক্ষতিগ্রস্ত অংশের সার্ভে চলছে। সার্ভে শেষে নকশা পরিবর্তন করে আবার কাজ শুরু করা হবে। এতে ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে।”
ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব মানুষ
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, জিরোপয়েন্ট থেকে পালারচর বাজার পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নদীতীরের কংক্রিট ব্লকও কয়েকটি জায়গায় ধসে পড়েছে। বহু মানুষ তাদের দোকানপাট ও ঘরবাড়ি সরিয়ে ভেতরের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
পোইলান মোল্লাকান্দি গ্রামের খলিল তালুকদার বলেন, “অর্ধঘণ্টার ভাঙনে আমার পাঁচটা ঘর আর এক বিঘা জমি নদীতে চলে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব। সময়মতো বাঁধের কাজ হলে আজ আমি পথে বসতাম না।”
আজিজুর রহমান মাদবর বলেন, “আমার বাড়ি আর পাঁচ-ছয় বিঘা জমি নদীতে চলে গেছে। সময়মতো বাঁধের কাজ শেষ হলে হয়তো পরের বর্ষায় বেঁচে যেতাম।”
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত আবু বকর আখন বলেন, “আমার বাড়ি আর চার বিঘা জমি নদীতে গেছে। এখন আত্মীয়ের বাড়িতে আছি। বাঁধের কাজ শুরু হয়েছিল দেখে স্বস্তি পেয়েছিলাম, কিন্তু ধীরগতির কাজ আমাদের সর্বনাশ করেছে।”
স্থানীয় ইউনিয়ন সদস্য মুজিবুর রহমান মাদবর বলেন, “শুকনো মৌসুমে কাজ করার কথা থাকলেও ঠিকাদাররা বর্ষাকালে কাজ শুরু করেছে। ফলে জিওব্যাগ সঠিকভাবে ফেলা যায়নি। এবার নদীর স্রোতও বেশি, কারণ নদী এখন ডান তীর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যদি আগে জিওব্যাগ ফেলা হতো, এ বিপর্যয় ঘটত না।”
প্রকল্পের পটভূমি
বিডব্লিউডিবি কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতুর নিম্নস্রোতে পূর্ব নাওডোবার জিরোপয়েন্ট থেকে বিলাসপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে।
নদীতীর রক্ষায় ২০২৩ সালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ৮৬০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়। প্রকল্পের আওতায় পূর্ব নাওডোবা, পালারচর, বরকান্দি, জাজিরা ও বিলাসপুর ইউনিয়নে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল।
পুরো প্রকল্পটি ৩১টি প্যাকেজে বিভক্ত, যা বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের ১৭ মে। প্রকল্পে বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলা ও পাথর ব্লক স্থাপন করে তীর সুরক্ষা পরিকল্পনা ছিল।
কিন্তু বর্ষা শুরু হতেই ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। প্রথমে পদ্মা সেতুর কাছাকাছি এক কিলোমিটার অংশ নদীতে ধসে পড়ে। পরে পূর্ব নাওডোবা থেকে পালারচরের কথরিয়াকান্দি পর্যন্ত ভাঙন আরও বাড়ে।
বর্তমানে প্রায় দুই কিলোমিটার বাঁধের অংশ নদীগর্ভে চলে গেছে বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ:
- ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ: ১,৮০০ মিটার
- ক্ষতিগ্রস্ত জিওব্যাগ: ৫.২৪ লাখ
- ক্ষতির পরিমাণ: প্রায় ৩৫ কোটি টাকা
- প্রকল্প ব্যয়: ৮৬০ কোটি টাকা
- গৃহহীন পরিবার: অন্তত ৪৫০
- নির্মাণাধীন মোট দৈর্ঘ্য: ৮.৬৭ কিলোমিটার
- দায়ী সংস্থা: বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি)
এই ভয়াবহ নদীভাঙন শরীয়তপুরের পদ্মা তীরবর্তী মানুষের জীবনে নতুন করে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।
