উত্তর কোরিয়ায় বিদেশি সিনেমা-ড্রামা দেখার দায়ে মৃত্যুদণ্ড, জাতিসংঘের নতুন প্রতিবেদন

জাতিসংঘের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়া ক্রমশই মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। এমনকি বিদেশি চলচ্চিত্র বা টিভি নাটক দেখা ও শেয়ার করার মতো কাজের জন্যও মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে দেশটির কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের জীবনের সবক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করেছে। নজরদারি ব্যবস্থা হয়েছে আগের চেয়ে বেশি বিস্তৃত, যেখানে প্রযুক্তিগত উন্নয়নকেও কাজে লাগানো হচ্ছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফোল্কার তুর্ক সতর্ক করে বলেছেন, “এভাবে চলতে থাকলে উত্তর কোরিয়ার জনগণকে আরও দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট, দমননীতি ও ভয়ের মধ্যে বাঁচতে হবে।”
মৃত্যুদণ্ডের ভয়
২০১৫ সালের পর থেকে অন্তত ছয়টি নতুন আইন যুক্ত হয়েছে, যা বিভিন্ন অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের অনুমতি দেয়। এর মধ্যে বিদেশি কনটেন্ট দেখা বা শেয়ার করার অপরাধও রয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাৎকার দেওয়া কয়েকশ’ পালিয়ে আসা উত্তর কোরিয়ান জানান, ২০২০ সালের পর থেকে বিদেশি কনটেন্ট বিতরণের দায়ে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে দেখেছেন তারা।
২০২৩ সালে পালিয়ে আসা কাং গিউরি বিবিসিকে জানান, তার তিন বন্ধুকে দক্ষিণ কোরিয়ার কনটেন্ট রাখার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এক বন্ধু মাত্র ২৩ বছর বয়সে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। “তাদের বিচার হয়েছিল মাদক অপরাধীদের সঙ্গে একসাথে। এখন এই দুই অপরাধকে একইভাবে দেখা হয়,” বলেন তিনি।
ভেঙে পড়া আশা
২০১১ সালে কিম জং উন ক্ষমতায় এলে অনেকেই আশা করেছিলেন জীবনমান উন্নত হবে। কিন্তু ২০১৯ সালে পশ্চিমা বিশ্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনীতি এড়িয়ে অস্ত্র কর্মসূচিতে জোর দেওয়ার পর মানুষের জীবনযাত্রা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
পালিয়ে আসা অধিকাংশ মানুষ জানান, পর্যাপ্ত খাবার নেই, দিনে তিনবেলা খাওয়া যেন “বিলাসিতা”। কোভিড মহামারির সময় খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়, বহু মানুষ অনাহারে মারা যায়।
সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠোর করায় মানুষ স্বাভাবিকভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছিল না। একই সঙ্গে সীমান্ত পাহারা বাড়ানো হয় এবং চীন সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করলেই গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
এক তরুণী জানান, “প্রথমদিকে আমাদের কিছুটা আশা ছিল, কিন্তু সেই আশা বেশিদিন টেকেনি। স্বাধীনভাবে বাঁচার পথ আটকে দেওয়া হয়েছে। জীবনের প্রতিটি দিন হয়ে উঠেছিল যন্ত্রণার।”
জাতিসংঘের আহ্বান
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশকে উত্তর কোরিয়ার সরকার নাগরিকদের উপর কার্যত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন নজরদারিকে আরও শক্তিশালী করেছে। এক পালিয়ে আসা নাগরিক বলেন, সরকার আসলে জনগণের চোখ-কান বন্ধ করতে চায়।
জাতিসংঘ উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক কারাগার তুলে দেওয়ার, মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার বন্ধ করার এবং মানবাধিকার শিক্ষা চালুর আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) পাঠানোর সুপারিশ করেছে। তবে এর জন্য নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন, যা চীন ও রাশিয়ার কারণে অনিশ্চিত।
সম্প্রতি বেইজিংয়ে সামরিক কুচকাওয়াজে কিম জং উনকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাশে দেখা গেছে, যা উত্তর কোরিয়ার কর্মকাণ্ডে এ দেশগুলোর নীরব সমর্থনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জাতিসংঘ হাইকমিশনার তুর্ক বলেন, “আমাদের প্রতিবেদন দেখায়, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম পরিবর্তনের জন্য স্পষ্টভাবে আকাঙ্ক্ষা করছে।”
তথ্যসূত্র: BBC