৬জি: ভবিষ্যতের দৌড়ে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে?

ছবিঃ ৬ জি নেটওয়ার্ক
ডিজিটাল যুগে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। দশ বছর আগেও ভিডিও বাফারিং আমাদের ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা নিত। আজ আমরা ৪কে (4K) রেজ্যুলুশনে ভিডিও স্ট্রিম করি, এক ট্যাপে ভিডিও কল করি, স্মার্ট হোম নিয়ন্ত্রণ করি। কিন্তু এরপর কী? উত্তর—৬জি (6G)। এটি এমন একটি প্রযুক্তি যা শুধু দ্রুততর সংযোগ নয়, বরং আমাদের জীবনযাত্রার পদ্ধতিই পাল্টে দিতে পারে।
৬জি প্রযুক্তি বাস্তব করবে হোলোগ্রাফিক কথোপকথন, তাৎক্ষণিক এআই সহায়তা এবং এক শক্তিশালী ইন্টারনেট যা আজকের কল্পনার বাইরেও। কিন্তু বড় শক্তির সঙ্গে আসে বড় প্রতিযোগিতা। ইতোমধ্যেই দেশ ও টেক জায়ান্টরা এই ৬জি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে প্রবল প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
৬জি কীভাবে বদলে দেবে জীবন?
ভাবুন তো, আপনার প্রিয় বন্ধুকে হোলোগ্রামে সামনে দেখে কথা বলছেন, গাড়ি নিজেই চালিত হচ্ছে নিখুঁতভাবে, রোবটের মাধ্যমে সার্জারি করছেন চিকিৎসক। সায়েন্স ফিকশন মনে হলেও, এগুলোই বাস্তবে আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ৬জি।
যদি ৫জি (5G) সাইকেল থেকে স্পোর্টস কারে আপগ্রেড হয়, তাহলে ৬জি যেন এক স্পেসশিপ। এটি আরও দ্রুত, আরও বুদ্ধিমান এবং এমনভাবে আমাদের সংযুক্ত করবে যা আমরা এখনও কল্পনাও করতে পারিনি।
৬জি অর্থ হলো “সিক্সথ জেনারেশন ওয়্যারলেস টেকনোলজি”। ইন্টারনেটকে ধরুন একটি হাইওয়ে হিসেবে। ৫জি মানে বেশ চওড়া ও দ্রুত রাস্তা, যেখানে অনেক গাড়ি চলতে পারে, তবু মাঝেমধ্যে ট্র্যাফিক জ্যাম হয়। কিন্তু ৬জি সেই রাস্তা আরও বড় করবে, আর তা থাকবে আকাশে। সেখানকার গাড়িগুলো উড়বে এবং কখনও জ্যামে পড়বে না।
৬জি ব্যবহার করবে টেরাহার্টজ (Terahertz) তরঙ্গ, যা প্রতি সেকেন্ডে ১ টেরাবাইট পর্যন্ত ডেটা পাঠাতে পারবে — ৫জির চেয়ে ১,০০০ গুণ দ্রুত। আপনি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ডাউনলোড করতে পারবেন মাত্র ১ সেকেন্ডে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ৬জি শুধু ফোন বা কম্পিউটার নয়, বরং বাড়ি, গাড়ি, কারখানা, এমনকি পুরো শহরকেও সংযুক্ত করবে।
কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে?
বর্তমানে ৬জি রেসে সবচেয়ে এগিয়ে চীন। চলতি বছরের মার্চে বেইজিং তাদের জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্য প্রকাশ করেছে, যেখানে ৬জি শিল্পকে অন্যতম অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তারা সফলভাবে স্যাটেলাইট থেকে গ্রাউন্ডে লেজার যোগাযোগ পরীক্ষাও সম্পন্ন করেছে, যেখানে ১০০ গিগাবিট প্রতি সেকেন্ড গতিতে ডেটা আদান-প্রদান হয়েছে।
হুয়াওয়ে (Huawei) ও জেডটিই (ZTE)-এর মতো প্রতিষ্ঠান এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে। সরকার একটি জাতীয় ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছে, যারা ৬জি নিয়ে গবেষণা ও বিনিয়োগ করছে।
অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলো কিছুটা পিছিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ‘নেক্সট-জি অ্যালায়েন্স’ (Next G Alliance) ভবিষ্যৎ ৬জি উন্নয়নের নেতৃত্ব দিতে চায়। ইউরোপেও ৬জি স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণের কাজ শুরু হয়েছে। কোয়ালকম (Qualcomm), নোকিয়া (Nokia) এবং AT&T-এর মতো প্রতিষ্ঠান গবেষণায় জড়িত। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমা দেশগুলো ৫জির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাইছে, তারপর ৬জিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
বাংলাদেশ ৬জি প্রতিযোগিতায় কোথায় দাঁড়িয়ে?
বিশ্ব যখন ৬জি প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতায় মত্ত, তখন প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? প্রতিবেশী ভারত যেমন আগেভাগেই পরিকল্পনা গ্রহণ করে গবেষণা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব শুরু করেছে, তেমনি বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোও এখন থেকেই নিজেদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতায় এখনও প্রাথমিক স্তরেই রয়ে গেছে।
৬জি নিয়ে বাংলাদেশে কী চলছে?
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ও টেলিকম খাত মূলত ৫জি প্রযুক্তি বিস্তারে মনোযোগী। ২০২১ সালের শেষ দিকে পরীক্ষামূলকভাবে দেশে ৫জি চালু হয় এবং সীমিত পরিসরে তার বাস্তবায়ন চলছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) এখনো ৬জি নিয়ে কোন স্পষ্ট জাতীয় নীতি বা রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি।
যদিও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছু প্রযুক্তি গবেষণাকেন্দ্র ও একাডেমিক প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতের টেলিকম প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছে, তবুও তা এখনো বিচ্ছিন্ন এবং সীমিত পর্যায়ে।
চ্যালেঞ্জসমূহ:
- প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির ঘাটতি: ৬জি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন টেরাহার্টজ তরঙ্গভিত্তিক অবকাঠামো, যা বাংলাদেশে এখনো অনুপস্থিত।
- গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ কম: বাংলাদেশে R&D (গবেষণা ও উন্নয়ন)-তে সরকার ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ এখনো অনেক পিছিয়ে, যা ৬জির মতো প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দিতে হলে অপরিহার্য।
- মানবসম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রয়োজন: ৬জি প্রযুক্তি বাস্তবায়নে দরকার অত্যাধুনিক স্কিলসেট—যেমন AI, IoT, Quantum Communication, Robotics—যার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল এখনো বাংলাদেশে পর্যাপ্ত নয়।
- আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব নেই বললেই চলে: যেখানে ভারত, চীন বা ফিনল্যান্ড ইতোমধ্যে একে অপরের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করছে ৬জি উন্নয়নে, বাংলাদেশ এখনো তেমন কোনো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বা সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর করেনি।
সম্ভাবনা কোথায়?
তবে হতাশার কিছু নেই। বাংলাদেশ এখনো উদীয়মান প্রযুক্তির বাজার, এবং এর তরুণ জনসংখ্যা, শক্তিশালী মোবাইল ব্যবহারকারীভিত্তি, ও দ্রুত বর্ধনশীল ডিজিটাল ইকোনমি ভবিষ্যতে একে ৬জি প্রস্তুতির জন্য সহায়তা করতে পারে।
যদি এখনই সরকার:
- একটি জাতীয় ৬জি রোডম্যাপ তৈরি করে,
- বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ায়,
- আন্তর্জাতিক টেলিকম সংস্থা ও দেশের টেলিকম অপারেটরদের সঙ্গে সমন্বয় করে
তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ৬জি রেসে যুক্ত হতে পারবে।
৬জি দুনিয়ার ভবিষ্যৎ, এবং দেরিতে শুরু করলেও পিছিয়ে পড়ার মানে এই নয় যে বাংলাদেশের সম্ভাবনা নেই।
যদি এখন থেকেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, প্রযুক্তিগত ও মানবসম্পদের উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশও ৬জি যুগে প্রবেশ করতে পারবে সম্মানের সঙ্গে।
বর্তমানে বাংলাদেশ যেখানে ৫জি স্থাপনায় সীমিত সফলতা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যতের প্রযুক্তি দৌড়ে টিকে থাকতে চাইলে এখন থেকেই ৬জি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করাই সময়ের দাবি।
ভারতের পরিকল্পনা: ভারত ৬জি ভিশন
ভারতও পিছিয়ে নেই। দেশটি একটি বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যার নাম ‘ভারত ৬জি ভিশন’। এর মূল লক্ষ্য ৬জি প্রযুক্তিতে ভারতকে একটি বৈশ্বিক নেতা হিসেবে গড়ে তোলা। ভারতের নেওয়া তিনটি বড় উদ্যোগ:
- গবেষণায় বিনিয়োগ: বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান একত্রে ৬জি উদ্ভাবনে কাজ করছে।
- আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব: ভারত ইতোমধ্যে জাপান এবং ফিনল্যান্ড-এর সঙ্গে অংশীদারিত্ব করেছে, যাতে জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিনিময় সম্ভব হয়।
- দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহ: রিলায়েন্স জিও (Jio) ও ভারতী এয়ারটেল (Airtel) ইতোমধ্যেই নিজেদের প্রস্তুত করছে ৬জি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে।
ভবিষ্যতের দিশা কী?
সব কিছু ঠিকঠাক চললে ২০৩০ সাল নাগাদ ৬জি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি আমাদের জীবন কতটা বদলে দেবে?
৬জি কি আমাদের এক নতুন যুগে নিয়ে যাবে, যেখানে আমরা আরও সংযুক্ত, আরও স্মার্ট হবো? নাকি এটি এমন সব চ্যালেঞ্জ আনবে, যা এখনও কল্পনাতীত?
একটি বিষয় নিশ্চিত—৬জি রেস শুরু হয়ে গেছে। আর যারা এতে বিজয়ী হবে, তারা শুধু প্রযুক্তির নয়, বরং বিশ্বের ভবিষ্যৎকেও গঠন করবে।